দয়াল কুমার বড়ুয়া

  ২৫ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা বৈদেশিক মুদ্রা

রেমিট্যান্স তথা বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের পরই রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ। কাজেই সরকার বিদেশে দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে বিশেষ সক্রিয় হলে বাংলাদেশের সুনাম ও রেমিট্যান্স আয় দুটোই বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ধরে রাখতে চাইলে স্বচ্ছতা ও সততা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, শ্রমশক্তি প্রেরণের বিষয়ে সামান্যতম দুর্নীতিও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধিকতর তৎপরতাই কাম্য।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তোলা এবং নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিলে উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রপ্তানি বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, একটি-দুটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে পূর্বাচল নিউ টাউনে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্রে মাসব্যাপী ২৮তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রপ্তানি আয় বাড়াতে তৈরি পোশাকের মতো পাট ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য এবং হস্তশিল্পসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যে একই গুরুত্ব দিতে হবে।

এক পণ্যে নির্ভরতা দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করেন। তবে দেশের অন্য কোনো খাতও এখন পর্যন্ত নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্পের কাছাকাছিও আসতে পারেনি। রপ্তানি ঝুড়িতে বৈচিত্র্য আনার সম্ভাবনা আছে- এমন খাতগুলোর মধ্যে আছে- চামড়া ও জুতা, হালকা প্রকৌশল এবং প্লাস্টিক। কিন্তু মাসিক রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই উৎপাদিত পণ্যগুলোর কোনোটিই এক নম্বর অবস্থানে থাকা খাতটির ধারে-কাছেও নেই। আরএমজি খাতের রপ্তানির হিসাব বিলিয়নে করা হলেও অন্যগুলোর হিসাব এখনো কয়েক মিলিয়নেই আটকে আছে।

রপ্তানির জন্য একটি বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভর করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সারা দেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসব অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হবে এবং যে অঞ্চলে যে পণ্য ভালো হয়, সেখানে সেই শিল্প গড়ে উঠবে। সেবা খাতেও আমাদের যথেষ্ট সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে ও ভালো সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ খাতে রপ্তানি আয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছে এবং আইসিটি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করার বিশাল সুযোগ সামনে রয়ে গেছে। আইটি খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি আয় ২৭.৫ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা বিদেশেও রপ্তানি করতে পারছি। যদিও বিশ্বমন্দার অভিঘাতে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক উন্নত দেশেও পণ্য চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। সেটা মাথায় রেখে নতুন বাজার আমাদের খুঁজতে হবে, নতুন জায়গায় যেতে হবে। ২৮তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তাৎপর্যের দাবিদার।

রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ ২৫টি পণ্য ৬৮টি দেশে রপ্তানি করে আয় করত মাত্র ৩৪৮ দশমিক ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত বছর অর্থাৎ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭৪৪টি পণ্য বিশ্বের ১৯৮টি দেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। আমাদের রপ্তানির প্রধান খাত দুটি। একটি পণ্য রপ্তানি আর একটি সেবা রপ্তানি। আমরা রপ্তানি বলতে শুধু পণ্যকে বোঝালেও সেবা খাতটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সেবা রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩ দশমিক ১৭৩ বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং সার্ভিস সেক্টরে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং সার্ভিস সেক্টরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ চীন হালকা প্রাযুক্তিক পণ্য থেকে ভারী ও জটিল প্রযুক্তির পণ্য তৈরিতে মনোযোগী হয়েছে। খেলনা, সাইকেল, হালকা ইলেকট্রনিক পণ্যে চীনের বাজার নিয়ে নেওয়ার দারুণ সুযোগ তাই বাংলাদেশের সামনে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য ব্যাপক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজন রপ্তানিসহায়ক শিল্পনীতি।

আজকের যুগ হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের যুগ। জাতীয় উন্নয়নের এটিই সোজাসাপটা পথ। বাংলাদেশের গত দেড় দশকে নজরকাড়া উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের বদৌলতে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে রপ্তানি যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। গুটিকয় পণ্যের ওপর নির্ভরতার বদলে বিদেশে কোন কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে, সে নিরিখে উদ্যোগ নিতে হবে। নিত্যনতুন বাজার সম্প্রসারণে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক

ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close