মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মতামত

সংস্কৃতির বিকাশে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র

ঢাকাসহ সারা দেশের সিনেমা হলে এখন আর দর্শক সমাগম নেই। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সিনেমা হল। অধিকাংশ দর্শক আজ চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অথচ ষাট-সত্তরের দশকে বাংলা সিনেমার কী এক সুবর্ণ সময় ছিল! ঢাকার গুলিস্তান হলে বাংলা আর ওপরতলার নাজে ইংরেজি সিনেমা দেখার মধুর স্মৃতি আজও হয়তো আজও অনেকে ভোলেননি। ছেলেবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি ভীষণ ঝোঁক ছিল আমার। বাবার হাত ধরে সিনেমা হলে গিয়ে উত্তমণ্ডসুচিত্রার অনেক ছবি দেখেছি। বাবা বলতেন, বাইরে অনর্থক ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে খানিকটা সময় সিনেমা হলে থেকে ভালো ছবি উপভোগ করা উত্তম। তাতে মন ভালো থাকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতে নির্মিত বেশির ভাগ বাংলা ছায়াছবি সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছি এবং পছন্দের ছবিগুলো যে কতবার দেখেছি তার হিসাব নেই। এমনকি এফডিসিতে গিয়ে রাত জেগে বহু ছায়াছবির চিত্রায়ণ, প্রজেকশন রুমে বসে চিত্রায়িত ছবির অংশবিশেষ দেখা যেন আমার নেশা হয়ে গিয়েছিল। একটি চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু থেকে এর চলচ্চিত্রায়ণের বিভিন্ন দিক আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। এফডিসিতে তখন ছিল আমার নিয়মিত আসা-যাওয়া। এফডিসির ছোট্ট পরিসরে মাত্র দুটি ফ্লোর। সীমিতসংখ্যক নায়ক-নায়িকা, কলাকুশলীর নীরব আনাগোনা। সে সময় বেশির ভাগ নায়ক-নায়িকারা রিকশা অথবা স্কুটারে চড়ে এফডিসিতে আসতেন। আনোয়ার হোসেন চড়তেন একটি মোটরসাইকেলে। পরে অবশ্য তাকে একটি নীল রঙের ছোট্ট একটি টয়োটা গাড়ি চালাতে দেখেছি। কাঁঠালবাগানের কোথাও তিনি ভাড়া বাসায় থাকতেন। সাদামাটা পোশাক। আনোয়ার হোসেনের মায়াময় চোখ আর মধুর কণ্ঠস্বরই আকৃষ্ট করত আমাকে। তার অভিনিত ‘সূর্যস্নান’ ছবিটি আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করেছে। পরে ‘নতুন দিগন্তের’ মতো প্রেমনির্ভর ছবি তাকে আরো জনপ্রিয় করে। ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছায়াছবিতে একজন সত্যিকারের নবাব সিরাজকে যেন খুঁজে পাওয়া যায় শিল্পী আনোয়ার হোসেনের মাঝে। তিনি হয়ে যান বাংলার মুকুটবিহীন নবাব। আরো পরে জহির রায়হানের জীবনঘনিষ্ঠ ছায়াছবি ‘জীবন থেকে নেওয়া’তে দর্শক একজন সফল মুক্তিকামী, সংগ্রামী যুবক হিসেবে তাকে দেখা যায়। ভদ্র, নম্র শান্ত প্রকৃতি এবং প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার অধিকারী শিল্পী আনোয়ার হোসেন দেশের একজন প্রতিভাবান শিল্পী হিসেবে আপামর সিনেমা দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন।

সেকালে চলচ্চিত্র শিল্পের কারিগরি মান তেমন উন্নত না হলেও সুস্থ ধারার অনেক ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান এবং আলমগীর কবীর বেশ কিছু ক্লাসিক্যাল ছবি বানিয়ে দেশ-বিদেশে সম্মান কুড়িয়েছেন। জয় করেছেন দর্শক হৃদয়। রাজ্জাক, হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন, কবরী, সুচন্দা, ববিতার মতো শিল্পীরাও অভিনয় প্রতিভার কম স্বাক্ষর রাখেননি। সত্যজিৎ রায়ও ববিতাকে দিয়ে ‘অশনিসংকেত’-এর মতো ছায়াছবি বানাতে সাহস করেছিলেন। এসব ছায়াছবি, অভিনেতা-অভিনেত্রীর কথা দেশের দর্শক আজও ভোলেনি। এরপর কেটে গেছে অনেক সময়। বর্তমান সময়ের ‘মাটির ময়না’, ‘জয়যাত্রা’র মতো ছবি এ দেশে তৈরি হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামের মতো বেশ কজন সর্টফিল্ম নির্মাতা তাদের কর্মে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন, সম্মান কুড়িয়েছেন। বিশেষ শৈল্পিক গুণের অধিকারী অকালপ্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ তো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’র পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সফল নাট্যব্যক্তিত নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুু আমাদের নিরাশ করেননি। তার গেরিলা ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ছয়টি পুরস্কার জিতে নেয়। ‘গেরিলা’ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু উঠে না এলেও যুদ্ধকালীন সময়ে রণাঙ্গনের কিছু দৃশ্য এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা যেভাবে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশে নির্মিত অন্য কোনো চলচ্চিত্রে খুব কম দেখা গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের কিছু ছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে। কুড়িয়ে আনছে সম্মান। দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের নায়ক-নায়িকা, ছবির কলাকুশলীরা হচ্ছেন পুরস্কৃত, সংবর্ধিত। বাংলাদেশের আগামী দিনের চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে গেলে ভালো করবেন।

বাংলা চলচ্চিত্রের কালজয়ী নায়িকা সুচিত্রা সেন না-ফেরার দেশে চলে গেলেও দেশ-বিদেশের যেকোনো বাংলা ছায়াছবির বিমুগ্ধ দর্শক তাকে স্মরণ রাখবে চিরকাল। ভারতের বাংলা ছায়াবিতে উত্তমণ্ডসুচিত্রা তাদের অভিনয় প্রতিভা দিয়ে এ দেশের লাখো কোটি বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন। এপার বাংলা ওপার বাংলার লাখো কোটি সিনেমা বোদ্ধার হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। বাংলা ছায়াছবির জগৎ আজও তার শূন্যতা অনুভব করে, বাংলা চলচ্চিত্রে আরেকজন সুচিত্রা সেন অদ্যাবধি তৈরি হয়নি। উত্তম অভিনীত, সত্যজিৎ রায় পরিচিালিত ‘নায়ক’ ছায়াছবিটি ভীষণ কৌতূহল নিয়ে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে উপভোগ করেছি। উত্তম কুমারের অকালমৃত্যু ভারতের বাংলা ছায়াছবির জগতে যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, তা আজও পূরণ হয়নি। আজও উত্তমণ্ডসুচিত্রা দুবাংলার কোটি মানুষের মধ্যে বেঁচে আছেন তাদের শিল্পকর্মের মধ্যে। সত্যজিৎ রায় তার বাংলা ছায়াছবি দিয়ে বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরকারে পরিচিত করেছিলেন। সিনেমাশিল্প আজ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আজ অন্যতম একটি প্রধান খাত।

আশির দশক থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে কোনো ছায়াছবি আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। কালেভদ্রে টেলিভিশনের পর্দায় বাংলাদেশে নির্মিত দু-একটি ফিল্ম দেখার সুযোগ মিলেছে যেগুলো দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছে। আজকাল বাংলাদেশে ভালো ছবি নির্মিত হচ্ছে কম। বরং আজেবাজে কাহিনি নিয়ে তৈরি বাস্তবতা বর্জিত ছবির ভিড়ে ভালো ছবি ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। শুধু ব্যবসা সফলতার দিক চিন্তা করে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে অশ্লীল ছবি, যা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনো রুচিশীল মানুষ দেখতে পারেন না। এসব ছবির পোস্টারে ছাপা হয় নায়িকার অশ্লীল দেহভঙ্গি। সস্তা বিনোদনপ্রত্যাশী এক শ্রেণির দর্শক এসব সিনেমা দেখেন। তরুণসমাজকে রুচিহীনতার দিকে ঠেলে দিতে এ ধরনের ছায়াছবি অনেকটা ভূমিকা রাখে। সিনেমাশিল্প যে শুধু বিনোদনমাধ্যম নয় তা যেন আজ বাংলাদেশের অনেক চলচ্চিত্রকার ভুলতে বসেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আজ যেন এক বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের কারিগরি মান আগের চেয়ে বেশ উন্নত হয়েছে। আজ সাদা-কালোর বদলে নিয়মিত রঙিন ছবি নির্মিত হচ্ছে। ছায়াছবি, ছায়াছবির কলাকুশলীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। হিট, সুপারহিট ছবিও তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান অবস্থার উত্তরণের লক্ষ্যে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। প্রয়াত জহির রায়হান ও আলমগীর কবীরের মতো চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্র নির্মাণে যে ধারা শুরু করেছিলেন, তার পথ ধরে বর্তমান চলচ্চিত্র নির্মাতাদের এগিয়ে যেতে হবে। অশ্লীল ছায়াছবি নির্মাণ এবং ভিডিও পাইরেসি বন্ধ করতে সবার একাত্ম হতে হবে। উন্নত শিল্পমানসম্পন্ন সুস্থ ধারার ছায়াছবি তৈরি করতে শিল্প-সাহিত্য সংশ্লিষ্টদের হতে হবে অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশের শিশু-কিশোরদের চরিত্র গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষামূলক শিশুতোষ ছায়াছবি নির্মাণে তৎপর হতে হবে। চলচ্চিত্র যে শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বলিষ্ঠ মাধ্যম তা ছায়াছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। এফডিসি ও ফিল্ম সেন্সর বোর্ডকে এ ব্যাপারে নিতে হবে বিশেষ দায়িত্বশীল ভূমিকা। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা বিশেষ জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকারের পর্যাপ্ত অনুদান প্রদান এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সময় প্রেক্ষাগৃহের টিকিট থেকে বিনোদন কর মওকুফ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি গুণী চলচ্চিত্র শিল্পী ও সংশ্লিষ্টদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিসহ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হলে তা চলচ্চিত্র শিল্পের মানোন্নয়ন ও বিকাশে সহায়ক হবে।

চলচ্চিত্র শিল্প দেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের একটি প্রধান মাধ্যম। সুস্থ ধারার শিল্প মানসম্মত চলচ্চিত্র দেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বর্তমান যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় থেকে ফিরিয়ে আনতে সুষ্ঠু ধারার চলচ্চিত্র ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা চলচ্চিত্র যেমন একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম তেমনি ভালো চলচ্চিত্র মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র চরিত্র গঠনেও রাখতে পারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। তাই আজকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখে দেশের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে তৎপর হলে ক্রমশ ভালো সিনেমা দেখার দর্শকও তৈরি হবে। ধীরে ধীরে খুলে যাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলো। সিনেমা হলের মানও উন্নত হবে। দর্শক আবার হলে ফিরতে শুরু করবে। দেশে তৈরি হবে নিত্যনতুন মানসম্মত ছায়াছবি। সুস্থ বিনোদনের সুযোগ পেলে নতুন প্রজন্ম খারাপ পথে পা বাড়াবে না। চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালকসহ সিনেমাশিল্পের সঙ্গে জড়িত সব কলাকুশলীরা আর্থিক লাভবান হবেন। বিকশিত হবে আবহমান বাংলার সুস্থ সংস্কৃতির ধারা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close