মোসাদ্দেক হোসেন

  ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

অবহেলিত উত্তরবঙ্গের শেষ কোথায়?

উইকিপিডিয়ার মতে, বাংলাদেশের উত্তর দিকে অবস্থিত ভৌগোলিক অঞ্চলকে বলা হয় উত্তরবঙ্গ। উত্তর অঞ্চলের দুই বিভাগ রাজশাহী বিভাগ ও রংপুর বিভাগকে একত্রে বলা হয় উত্তরবঙ্গ। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ অনগ্রসর বা অবহেলিত বলে পরিচিত। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও মঙ্গা এ শব্দত্রয়ের সমন্বয়ে গঠিত উত্তরাঞ্চল। ‘মঙ্গা’ শব্দটি কর্ণপাত হতেই মনে ভেসে ওঠে উত্তরাঞ্চলের কথা। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা উত্তরবঙ্গ। আর রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য শ্রেণির মানুষের বাস। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, উন্নয়নশীল বাংলাদেশের দশটি দারিদ্র্য জেলার মধ্যে পাঁচটিই রংপুর বিভাগে। জেলা পাঁচটি হলো রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। আর বেশির ভাগ ফসল উৎপাদিত হয় রংপুর অঞ্চল থেকে। সোনালি আঁশ পাট, তামাক, বাদাম, আলু ও ধান উৎপাদনে শীর্ষে রংপুর অঞ্চল। শরীরের রক্ত পানি করা সরল মানুষগুলো কখনো তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পায়নি। সর্বদা যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায়। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিও যেন অবহেলিত মানুষগুলোর সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করেই যাচ্ছে। প্রতি বছর রুটিন অনুযায়ী বন্যা হয়ে থাকে। এ বন্যা সব স্বপ্ন ও সম্বলটুকু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বন্যার কারণে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারীর অধিকাংশ ফসলি জমি পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। ফলে বাড়িঘর, গবাদি পশু সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে যে সহায়তা আসে তা দিয়ে কতটুকু কেটে উঠতে পারে তা ভাবনার বিষয়।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সিকিম থেকে নেমে এসেছে তিস্তা নদী। কিন্তু তিস্তা জনপদের মানুষ কখনো সঠিক সময়ে পানি পায় না। খরা মৌসুমে পানির অভাবে ফসল আবাদ করতে পারে না। উপরন্তু বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তিস্তার ওপর নির্মিত গজলডোবা বাঁধ ভরা বর্ষা মৌসুমে খুলে দেওয়া হয়। যার ফলে লাখ লাখ হেক্টর ফসলাদি ভেস্তে যায়। এসব নানা ক্ষয়ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ পেতে, ২০২৩ সালের ২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের এক মহাসমাবেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন। যদিও তিস্তা মহাপরিকল্পনা অনেক বছর আগের এক আলোচিত বিষয়। চীন সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ১১৫ কিলোমিটারে ব্যাপক খনন চালিয়ে নদীর মাঝখানের গভীরতাকে ১০ মিটারে বাড়িয়ে ফেলা হবে এবং নদীর প্রশস্ততাকে ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলা হবে। একই সঙ্গে রিভার ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। উপযুক্ত স্থানে বেশ কয়েকটি ব্যারাজ কাম রোড নির্মাণ করে নদীর দুই তীরের যোগাযোগ নিশ্চিত করা হবে।

পাশাপাশি বর্ষাকালে প্রবাহিত নদীর বিপুল উদ্বৃত্ত জলরাশি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ করে, খাল খননের মাধ্যমে নদীর উভয় তীরের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা করা হবে। নদীর উভয় তীরের সড়কের পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সুবিধা গড়ে তোলা হবে। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য স্বপ্নের মতো।

অতীতে মুঘল সম্রাটরা এ অঞ্চল থেকে বিশাল অঙ্কের খাজনা আদায় করত। নুরলদিনের ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’ জমিদার তথা ব্রিটিশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষের ডাক। আর এ ডাকটির উৎপত্তি উত্তর জনপদ থেকেই। এ অঞ্চলের সাহসী মানুষ অন্যায় জুলুম আর বর্বরতার কাছে নত স্বীকার করেনি। উইলিয়াম হান্টারের তথ্য মতে, ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে রংপুরের কৃষক দল হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং রাজস্ব আদায়কারীদের বিতারিত করে। নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। নারীদের শিক্ষাব্যবস্থার

পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। নারী শিক্ষাব্যবস্থার বিপ্লব করলেও উন্নয়নের দিকে উত্তরবঙ্গের পরিবর্তন নেই বললেই চলে।

ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি শিল্প-কারখানা রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। ঢাকা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে। দেশের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মেগা ইন্ডাস্ট্রি, ক্ষুদ্র ইন্ডাস্ট্রি, মাঝারি ইন্ডাস্ট্রি সবগুলো এ অঞ্চল জুড়ে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট ইন্ডাস্ট্রি আরএমজি সেক্টর। এ সেক্টরের সব শাখা দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যমান।

উত্তরবঙ্গ পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ ভৌগোলিক দূরত্ব। ভৌগোলিক দূরত্ব বেড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত না হওয়ার কারণে। রাজধানী থেকে উত্তরবঙ্গের যাতায়াতে ১৪-১৫ ঘণ্টা লেগে থাকে। নামে হাইওয়ে সড়ক হলেও বাস্তবে রাস্তা অনেক চিকন। ব্যবসা-বাণিজ্যের মালামাল যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা পাওয়া যায় না। দেশের জলপথ, আকাশপথ, স্থলপথ সবদিক থেকে চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের অন্যান্য প্রান্তে যোগাযোগ ভালো। দেশের সবচেয়ে বড় হাইওয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম। সব সমুদ্রবন্দর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। উত্তরবঙ্গে যেহেতু সমুদ্র নেই, তাহলে সমুদ্রবন্দর না হওয়াই স্বাভাবিক। তবে আকাশপথ ও স্থলপথ উন্নয়ন করা সময়ের দাবি। আকাশপথের জন্য তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে অবস্থিত। ব্যবসার ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য বেশি সুবিধা দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলকেন্দ্রিক। সড়ক, যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক হয়েছে উত্তরাঞ্চলে। এ অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন ট্রেন। অল্প টাকায় ভ্রমণ সম্পন্ন হওয়ায় ট্রেনে যাতায়াতকেই উত্তরাঞ্চলের মানুষ প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর বুড়িমারী। রাজধানী ঢাকা থেকে বুড়িমারী পর্যন্ত সরাসরি একটি ট্রেন উদ্বোধন করার আশ্বাস দিয়েছে সরকার। ‘বুড়িমারী এক্সপ্রেস’ নামে ট্রেনটি এখনো চালু হয়নি। অনেক বছর থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য প্রহর গুনছে।

উন্নয়নশীল বাংলাদেশে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এসব প্রজেক্ট বাংলাদেশকে এক অনন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, বুড়িমারী এক্সপ্রেস চালু করলে দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে উত্তরবঙ্গও এগিয়ে যাবে। এসব বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

লেখক : শিক্ষার্থী, আল-কোরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close