মো. মনিরুল ইসলাম

  ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

সড়ক দুর্ঘটনা : আর কত কাঁদতে হবে

ছোটবেলায় মাদ্রাসায় যাওয়ার আগ্রহ বাড়ানোর জন্য আব্বা প্রায়ই বলতেন ‘লেখা পড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে’। বড় হতে না হতেই আবার মা বলতেন গাড়ি-ঘোড়ার পথ ভালো না অর্থাৎ প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটত বলে এমন অর্থে কথাগুলো বোঝাতেন।

এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আজ খুব মনে পড়ে সেই দিনের বাস্তব কথাগুলো। দিন দিন কেন এমন অবনতি বাংলাদেশের সড়ক ও যানবহন সেক্টরে? তবে কি সত্যিই গাড়ি-ঘোড়ার পথ ভালো না? নাকি কোনো দিনও আস্থা রেখে বলতে পারব না আমাদের দেশ শতভাগ সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত। যেমনটি বলা হয় শতভাগ বিদ্যুৎ উন্নয়নের দেশ। হরহামেশাই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটে যাওয়া মৃতের লাশ, সন্তানের বোবা কান্না, মায়ের আর্তনাদ, স্বামীহারা স্ত্রীর বুক ভরা বেদনা কিংবা পরিবারের একমাত্র উপার্জন সক্ষম মানুষটিকে হারানোর শোক। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান সত্যিই অবাক করে দেয় আমাদের।

সম্প্রতি, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৬ হাজার ৫২৪ জনের। এ সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৯১১টি। একই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় ১১ হাজার ৪০৭ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৯৭৪ জন বা ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ, শিশু ১ হাজার ১২৮ জন বা ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ।

এসব দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ১১ হাজার ৩৬৬টি। ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানবসম্পদের ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ১৬ হাজার ৯১০ কোটি ৩ লাখ ৪৮১ টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, সে জন্য এই হিসাবের সঙ্গে আরো ৩০ শতাংশ যোগ করার কথাও বলা হয়। এ সময় ২ হাজার ৫৩২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২ হাজার ৪৮৭ জন, যা নিহতের ৩৮ দশমিক ১২ শতাংশ, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ১ হাজার ৪৫২ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোটের ২২ দশমিক ২৫ শতাংশ, যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৯৪২ জন, যা ১৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ, এই সময়ে ১০৭টি নৌদুর্ঘটনায় ১৪৮ জন নিহত, ৭২ জন আহত এবং ৪৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন, ট্রলার ডুবে ৩৩টি গরুর মৃত্যুও ঘটেছে। এ ছাড়া ২৮৭টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২৪৩ জন নিহত এবং ৩৩৬ জন আহত হয়েছে। পুরুষ ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশ, নারী ১০ দশমিক ২০ শতাংশ এবং শিশু ৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

জানা গেছে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনাসমূহ রাতে এবং সকালে বেশি ঘটেছে।

এমন দুর্ঘটনার জন্য অনেক বিষয়ের প্রতিও রয়েছে বেখেয়াল। বিশেষ করে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, চালকদের বেতন-কর্ম ঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, মাদকাসক্ত হয়ে গাড়ি চালানো, প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালানোর জন্যও এমন দুর্ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিসির সক্ষমতারও অনেক ঘাটতি রয়েছে, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি প্রভৃতির কারণে এত দুর্ঘটনা ঘটছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

সব সেক্টরে দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার মৃত্যু সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। ২০২৩ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৫৩২টি। এতে নিহত হয়েছে ২ হাজার ৪৮৭ জন্য, আহত হয়েছে ১ হাজার ৯৪৩ জন। এর মধ্যে ৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সি, অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫ দশমিক ৭০ শতাংশ, মোটরসাইকেলে ভারী যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪০ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং অন্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ।

অন্যদিকে, শিশুমৃত্যু আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১২৮টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিশুমৃত্যের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাতীয় চালক হিসেবে নিহত হয়েছে ৩২৯ শিশু। রাস্তা পারাপার ও রাস্তা ধরে হাঁটার সময় যানবাহনের চাপায় মৃত ৫৩২ শিশু, মোটরসাইকেল আরোহী হিসেবে ২৬৭ শিশু, এসব দুর্ঘটনার মধ্যে জাতীয় মহাসড়কে ৩৩৮ শিশু, আঞ্চলিক সড়কে ৪১৬ শিশু, গ্রামীণ সড়কে ৩২৮ শিশু এবং শহরের সড়কে ৫০ শিশু নিহত হয়েছে।

এদের মধ্যে ১ মাস থেকে ৫ বছর বয়সি শিশু নিহত হয়েছে ২১৫ জন, ৬ থেকে ১২ বছর বয়সি শিশু নিহত হয়েছে ৪৯২ এবং ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি শিশু নিহত হয়েছে ৪২১ জন।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালের দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ১ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৪ এবং আহত বেড়েছে ৬৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের দুর্ঘটনা বেড়েছে ১ দশমিক ২ শতাংশ, প্রাণহানি কমেছে ১৫ দশমিক ৪১ এবং আহত কমেছে ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ অর্থাৎ দিনে সর্বোপরি গড়ে প্রায় ১৮ জনের প্রাণহানি ঘটে থাকে। নানা কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ওই ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এড়াতে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি সুস্থধারার চিন্তা লালন করলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি।

তাই জনসাধারণ থেকে শুরু করে আপামর জনতা পর্যন্ত ট্রাফিক আইনশৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে, রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়কপথের ওপর চাপ কমাতে হবে। পরিশেষে, কঠোরভাবে সড়ক ও পরিবহন আইন ২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুবা এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় আমাদের পরিবার, জাতি এবং দেশ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, আল ফিকহ্ বিভাগ, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close