আজগারুল ইসলাম

  ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

‘শরীফ থেকে শরীফা’ লাভ কার?

শিক্ষা হলো দৈনিক আহার্যের মতো। আমরা যখন খাদ্যগ্রহণ করি, তখন সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের শরীরে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করি না। কিন্তু ধীরে ধীরে এই খাবারের নির্যাস থেকেই আমাদের অজান্তেই শরীর পরিচালিত হয়। ঠিক তেমনি শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি বিষয়কে নিছক মুখস্থ করে পরীক্ষা পার করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হলেও বিষয়টির মধ্যে যে চেতনা নিহিত সেটি শিক্ষার্থীর মনে ওতপ্রোতভাবে গেঁড়ে বসে। চেতনা বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রতিটি বিষয় হোক সেটা সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতিবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস প্রতিটি বিষয়ই পরোক্ষভাবে একজন লেখকের মধ্যকার চেতনাই প্রকাশ করে। আমার মনে হয় একজন মানুষের জীবনীশক্তি হিসেবে খাদ্যকে বিবেচনা না করে চেতনাকে বিবেচনা করাই শ্রেয়।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর করলে আমরা বেশ কয়েকটি নতুন সংযোজন লক্ষ করছি। এই যে নতুন নতুন সংযোজন লক্ষ করছি, এর পেছনে মূল প্রভাবক হিসেবে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সেটি হলো চেতনা। যেমন বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে সপ্তম শ্রেণির বইয়ে উল্লিখিত শরীফার গল্প। এখন আমরা যদি এই গল্পের পেছনের চেতনাটাকে একটু লক্ষ করি তাহলে কি দেখতে পাই? আচ্ছা, এ প্রশ্ন পরে আসি। আগে গল্পটির বিষয়বস্তু নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। এখানে দেখা যাচ্ছে, একজন ছেলে ছেলেদের সব বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও নিজেকে মনে মনে মেয়ে মনে করছে। শুধু এই মনে করা টুকুই কি যথেষ্ট হবে তার জন্য, একটি মেয়ের বৈশিষ্ট্য বহন করার জন্য? শুধু এইটুকু মনে করলেই কি সে অন্য আরেকটি মেয়ের সঙ্গে একটি সাধারণ মেয়ের ভূমিকা অবতীর্ণ হতে পারে?

বিষয়টি যেহেতু মনের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেহেতু বিশ্ববিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটি তত্ত্ব এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। ফ্রয়েড বলেছিলেন, ‘ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মানুষ যে কাজই করুক না কেন, সেটা তার ভেতরে লুকায়িত কাম তাড়না থেকে করে থাকে।’ এ ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীরা আরো শক্তিশালী একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন যখন একটি বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে তখন তার মধ্যেও একটি কামশক্তি বিদ্যমান থাকে এবং এটি তার ভেতরে থাকে তার অজান্তেই। সর্বপ্রথম বাচ্চাটি তার কাম বা যৌনতার সাধ পেয়ে থাকে তার মায়ের কাছ থেকে Oral sex -এর মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ বাচ্চাটি মুখ দিয়ে দুধপান করছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মা হচ্ছেন বাচ্চার প্রথম প্রেমিকা। যেটাকে Oedipus complex হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মেয়ে বাচ্চার ক্ষেত্রে বাবার প্রতি যে প্রাথমিক আগ্রহ (যৌনতার দিক দিয়ে) সেটাকে Electra Complex হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে বাবা হচ্ছেন মেয়ের প্রথম প্রেমিক।

অতঃপর আস্তে আস্তে যখন সে বড় হতে থাকে চারদিকের নৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সে পরিচিত হতে থাকে। এভাবে একপর্যায়ে সে পূর্ণাঙ্গ হয় এবং সে তার চারদিকের সামাজিকতা রক্ষা করার জন্য নিজের কামশক্তিকে দমন করে রাখে। কিন্তু পরোক্ষভাবে এটি একটি প্রভাবক হিসেবে তার সব কাজকে প্রভাবিত করে।

মনোবিজ্ঞানীদের ধারণায় একজন মানুষের কামশক্তি যখন এতটাই প্রবল যে তার সুপ্ত অবস্থাতেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেখানে মেয়ে কল্পনা করা একজন ছেলের কাছ থেকে তার সমাজকে নিরাপদ মনে করা কি মোটেও শোভনীয় হবে? বা অন্য মেয়েরা কি তাদের কাছ থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে?

ধরুন একজন ট্রান্সজেন্ডার সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেল। এখন তাকে হল বরাদ্দের ক্ষেত্রে কাদের হলে বরাদ্দ দেওয়া হবে? যদি তার কল্পনা মোতাবেক তাকে মেয়েদের একটি হলে তাকে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাহলে অন্য মেয়েরা কি এতে করে স্বস্তি বোধ করবে?

এবার আসি স্বাধীনতার প্রশ্নে। যদি আপনি বলেন এটা স্বাধীন দেশ এবং এটি তাদের স্বাধীনতা। তাহলে বলব, আপনি আপনার স্বাধীনতাকে ততটুকু পর্যন্ত পালন করতে পারবেন, যতক্ষণ না অন্য কেউ আপনার স্বাধীনতা পালনে বিব্রতবোধ না করে। কিন্তু এখানে আপনি কি আপনার সীমাকে অতিক্রম করছেন না?

এবার এর পেছনে যে চেতনা আসল প্রভাবক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সেটি একটু দেখা যাক। সপ্তম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী যখন শরীফার গল্প অধ্যয়ন করবে, ঠিক এ বয়সে একজন ছেলে বা মেয়ের পক্ষে বিষয়টি এত গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এখনে খুব সাধারণভাবেই একজন ছেলে বা মেয়ে বিষয়টি আত্মস্থ করবে এবং ক্লাসে পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সাময়িকভাবে এখানেই চুকে যাবে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল পড়বে তার পরিণত জীবনে। যখন সে পরিণত বয়সে উপনীত হবে, তখন ওই যে বিষয়টি সে ছোট বেলায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পার করে এসেছে, কাজেই তার মস্তিষ্কে বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই প্রতিফলিত হবে। আর এর ফলে কী হবে? এর ফলে তার কাছে সমকামিতা একটি সাধারণ বিষয়, ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে পরিণত হবে। একজন ছেলে বা মেয়ের একসঙ্গে রুম বা বেড শেয়ার করা তার কাছে একটি স্বাভাবিক বিষয় বলে প্রতীয়মান হবে। তখন এই সপ্তম শ্রেণির গল্পটি তার কাছে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।

তাহলে মূলত এ প্রক্রিয়ার পেছনে সবশেষে কোন ধরনের চেতনা মুখ্য ভূমিকা পালন করছে, সেটি আমরা একটি বিষয় লক্ষ করলেই পরিষ্কার দেখতে পাই। বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে কিছু মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করছি এবং তারা কোন ধরনের মানসিকতা পোষণ করেন সে সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত নই। এই ভদ্রলোকরাই তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এটিকে ব্যবহার করছেন। এর সর্বশেষ ফলাফল হবে ধর্মীয় মূল্যবোধহীনতা, ধর্ষণ, ব্যাভিচারের ছড়াছড়ি। কিন্তু তখন আর এটিকে অপরাধ বলে মনে হবে না। অধিকন্তু একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হবে। লাখ লাখ নাম পরিচয়হীন শিশু জন্মগ্রহণ করবে। যাদের কাজে লাগিয়ে তারা তাদের উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে। তখন ওই সপ্তম শ্রেণির শরীফার গল্পই তাদের মস্তিষ্কে নির্যাস হিসেবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close