শফিকুল ইসলাম খোকন

  ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

দেশ ও জীবন বাঁচাতে জলাভূমি রক্ষা জরুরি

জল ও মাটি অর্থাৎ পানি আর মাটির সঙ্গে সবাই পরিচিত। পানি এবং মাটি দুটি একে অন্যের পুরিপুরক, অবিচ্ছেদ্য; পানি ছাড়া যেমন মানুষ জীবন বাঁচে না, তেমনি মাটি ছাড়াও মানুষের জীবন কল্পনাও করা যায় না। গ্রামীণ জনপদে একটি সময় ছিল মাটি আর পানি একাকার ছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে তা বিলুপ্তির পথে। জল আর মাটি অর্থাৎ জলাভূমি বাঁচলে আমাদের জীবন বাঁচবে, শুধু মানুষের জীবন নয়, পশু, পাখি, বন, বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য। বাঁচবে দেশ। তাই দেশ ও জীবন বাঁচাতে জলাভূমি রক্ষার বিকল্প নেই।

জলাভূমি হলো এমন একটি স্থান বা এলাকা, যার মাটি মৌসুমভিত্তিক বা স্থায়ীভাবে আর্র্দ্র বা ভেজা থাকে। রামসার কনভেনশন অনুযায়ী জলাভূমি বলতে বোঝায় নিচু ভূমি; যার পানির উৎস প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম; পানির স্থায়িত্বকাল সারা বছর কিংবা মৌসুমভিত্তিক; পানি স্থির কিংবা গতিশীল; স্বাদু, আধা-লবণাক্ত বা লবণাক্ত, এ ছাড়া কম গভীরতাসম্পন্ন সামুদ্রিক এলাকা যার গভীরতা ৬ মিটারের কম ও অল্প স্রোতযুক্ত।

প্রতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালিত হয়, যদিও ১৯৯৭ সালের আগে বিভিন্ন উদ্যাগ নেওয়া হয়; তবে এ সাল থেকেই প্রথম। প্রতি বছরই পৃথিবীর জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব এবং এর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক এবং উন্নয়নধারাকে বিবেচনা করে প্রতি বছরের জন্যই এক একটি প্রতিপাদ্য তৈরি হয়। বাংলাদেশেও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন দিবসটি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে। ২০১৯ সালের জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘জলাভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন’, ২০২০ সালের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য’। ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘জলাভূমি ও জল অবিচ্ছেদ্য এবং জীবনের জন্য অপরিহার্য’। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেসকো এ বছর জলাভূমি দিবসের সঙ্গে বনের সম্পর্ক তুলে ধরেছে। এবারের বিশ্ব জলাভূমি দিবসের স্লোগান ছিল ‘বনের জন্য পানি ও জলাভূমি’।

আমরা মাছে ভাতে বাঙালি, আমাদের দেশকে বলা হয়ে থাকে নদীমাতৃক দেশ। জলের দেশ বাংলাদেশে জলাভূমির অবস্থা কী? প্রতিনিয়তই জলাভূমি খুন করেই গড়ে উঠছে দালানকোঠা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীনালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশকে ঘিরে রেখেছে। পত্রিকার পাতা খুললে আর টিভিরে পর্দা দেখলে দেশের জলাভূমি চিত্র উঠে আসে। প্রতিনিয়তই জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, এ দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত, যা আমাদের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ ভাগ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জলাভূমি। এ দেশের প্রাকৃতিক স্বাদু পানির মাছের প্রধান উৎস হলো হাওরের বেসিন অঞ্চল। জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে এ দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদাহরণ হলো হাওর অঞ্চল ও সুন্দরবন। এ ছাড়া আড়িয়ল বিল ও চলনবিল এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। পৃথিবী বিখ্যাত সুন্দরবন সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধু সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত সাইক্লোনের হাত থেকে এ দেশ বাঁচানো এক অতন্দ্র প্রহরী হলো সুন্দরবন। ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট (রামসার কনভেনশন কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জলাভূমি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আরেক নিদর্শন হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে এখানে। বরগুনার পাথরঘাটা হরিণঘাটায়ও

রয়েছে অসংখ্য অতিথি পাখির অভয়ারণ্য, বনাঞ্চল। জীববৈচিত্র্যসহ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এ জলাভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, হাওরাঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ ২৫ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের প্রাণ এই জলাভূমি, তথা নদী, নালা, হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। সাংবিধানিকভাবেও এর গুরুত্ব স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮-ক-এর অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন, যা সরকারের পরিবেশবান্ধব নীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায়।’ কিন্তু সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ, পরিবেশদূষণ, জনসংখ্যার চাপসহ নানা কারণে এ দেশের জলাভূমিগুলোর প্রায় প্রতিটিই কমবেশি বিপদের সম্মুখীন। হারিয়ে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ নানা উদ্ভিদ ও প্রাণী। বহু জীব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। অনেকের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০-এর ১৮৭ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, ‘...বদ্ধ জলমহাল বলিতে এরূপ জলমহাল বোঝাইবে যাহার চতুঃসীমা নির্দিষ্ট অর্থাৎ স্থলবেষ্টিত এবং যাহাতে মৎস্যসমূহের পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে মৎস্য ধরার উপযোগী। সাধারণত, হাওর, বিল, ঝিল, হ্রদ, দিঘি, পুকুর ও ডোবা ইত্যাদি নামে পরিচিত জলমহালকে বদ্ধ জলমহাল বলিয়া গণ্য করা হয়’। জাতীয় পানি নীতিতে আরো উল্লেখ আছে, ‘...হাওর, বাঁওড় ও বিলজাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে জলাশয় আইন, ভূমি আইন, বন আইন, পরিবেশ আইন, পানি আইন, জীববৈচিত্র্য নিয়ে আইনসহ নানা আইন রয়েছে। কিন্তু এ আইনের কোনো কার্যকর বা বাস্তবায়ন নেই। আইন বাস্তবায়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, জলাভূমি রক্ষা যাই বলি না কেন, সবকিছুই আমাদের মানসিকতার ওপর নির্ভর করে, এ ছাড়া রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করে। প্রথম আমাদের রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক নেতাদের আন্তরিক হতে হবে এবং তাদের এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে এসব কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের দেশ বাঁচাতে হলে জলাভূমি বাঁচাতে হবে, আমাদের বাঁচতে হলে জলাভূমি রক্ষা করতে হবে। আসুন আমরা নিজেদের বাঁচাতে দেশ রক্ষা করতে জলাভূমি সুরক্ষায় এগিয়ে আসি।

লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close