ইমরান ইমন

  ২৮ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

পাঠ্যবই ছেঁড়া ও আমাদের দায়

সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসিফ মাহতাব নামের এক শিক্ষক জাতীয় শিক্ষক ফোরামের ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক : বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে জনসম্মুখে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘শরীফ’ থেকে ‘শরীফা’ হওয়ার গল্পটি ছিঁড়ে ফেলেন, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

আসিফ মাহতাব অভিযোগ করেন, ‘সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবই “শরীফ” থেকে “শরীফা” হওয়ার গল্প আছে। আমি বইটি বাজার থেকে কিনে নিয়ে এসেছি। এখানে লেখা আছে ছোটবেলা সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজেই একসময় বুঝলাম আমার শরীরটা ছেলের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। সে (ছেলে) যদি মেয়ে হয় তাহলে তার বিয়ে হবে কার সঙ্গে? অবশ্যই ছেলের সঙ্গে। তার মানে এটা সমকামী, যা আমাদের দেশে অবৈধ। কিন্তু সেটাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে এই গল্পের মাধ্যমে। এটা তো স্কুলে ছেলেমেয়ের এক ধরনের ব্রেনওয়াশের মতো করা হচ্ছে, যেটা ইউরোপ-আমেরিকায় করা হয়।’

এ ঘটনার পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে সপ্তম শ্রেণির এই বইয়ের ওই গল্পটি পড়েছি। কিন্তু এখানে নেতিবাচক কোনো কিছুই পাইনি, যা আসিফ মাহতাব অভিযোগ করেছেন এবং দেশ জুড়ে জনসাধারণের মধ্যে সরকারি পাঠ্যবই নিয়ে আতঙ্ক ও নেতিবাচকতা ছড়িয়েছেন। ইতিমধ্যে সেটার প্রভাব প্রতীয়মান।

এই গল্পটি পড়ে যা পেলাম, আমাদের সমাজে যে হিজড়া বলে একটা সম্প্রদায় আছে এবং তারাও যে আমাদের মতো মানুষ- সেখানে সে সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে। তাদের জীবনাচরণ, সমাজে চলতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার শিকার হওয়া এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের এগিয়ে যাওয়া- এসব নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে সে গল্পে। তা ছাড়া তারাও যে সাধারণের মতো মানুষ, তাদের ঘৃণা করা যাবে না- সে বিষয়টিরও উল্লেখ করা হয়েছে।

সেখানে একটি লাইন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে- ‘একজন মানুষকে বাইরে থেকে দেখেই কি সব সময় সে ছেলে না মেয়ে তা বোঝা যায়’। এখানে অযৌক্তিক বা অশালীনতার কী আছে? বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিক এবং একই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম হিজড়া পররাষ্ট্র ক্যাডার ওয়ালিদ ইসলাম। কূটনীতিক হওয়ার আগে কেউই জানত না তিনি ছেলে, নাকি মেয়ে, নাকি হিজড়া। তাকেও এ সমাজের কাছে অনেক হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়েছে, জীবনে চলার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। আর এ ধরনের বিষয়গুলোর কথাই ওই গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে।

আসিফ মাহতাব জনসম্মুখে সবার সামনে শুধু সরকারি পাঠ্যপুস্তক ছিঁড়েই ক্ষান্ত হননি। সেমিনারে সবার উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা এই বইটি বইয়ের দোকান থেকে ৮০ টাকা দিয়ে কিনে গল্পটির পাতা দুটি ছিঁড়বেন। পরে দোকানে আবার দিয়ে দেবেন। দিয়ে বলবেন, সেটি অর্ধেক দামে বিক্রি করতে। যাতে মানুষ সতর্ক হয়। প্রতিবাদটা এমন হতে পারে “শরীফ” থেকে “শরীফা” হওয়া পাতা দুটি ছিড়ে আবার তাদের (দোকানদার) কাছে দিয়ে দেব। আমার টাকা দিয়ে আমি ছিঁড়ব।’

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আসিফ মাহতাব জনসম্মুখে সরকারি পাঠ্যবই ছিঁড়ে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছেন, সেটার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় শাস্তির দাবিদার। এর মধ্য দিয়ে তিনি উগ্রতাকে প্রমোট করেছেন। পাঠ্যবইয়ের কোনো লেখা নিয়ে তার অভিযোগ থাকলে সেটা যুক্তি দিয়ে সুন্দরভাবে শালীনভাবে বিশ্লেষণ করতে পারতেন, যথাযথ কারণ দেখাতে পারতেন- কেননা তার পরিচয় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু জাতীয় একটা সেমিনারে জনসম্মুখে সরকারি পাঠ্যবই তিনি ছিঁড়তে পারেন না। যে সম্প্রদায়ের মানুষদের কেন্দ্র করে তিনি তুলকালামকাণ্ড ঘটিয়েছেন সে মানুষদের তথা হিজড়া জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালের নভেম্বরে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেটও প্রকাশ করা হয়।

দেশ জুড়ে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আসিফ মাহতাবকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছেন। সেটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কিন্তু এ ঘটনার পর হুজুগে কাণ্ডজ্ঞানহীন অতি আবেগী মানুষরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্র্যাকের সব প্রতিষ্ঠান ও পণ্য বয়কটের হুমকি দিচ্ছেন।? এতে ব্র্যাকের কিছুই হবে না, উল্টো ব্র্যাকের মার্কেটিং হবে।

সংশ্লিষ্ট কোনো ঘটনা ঘটলে এ দেশের মানুষের চিন্তা ও কাজ গিয়ে ঠেকে শুধু প্রতিষ্ঠান ও পণ্য বয়কটে। কিন্তু শেষমেশ সেটা কোনো ফল বয়ে আনে না। পরিবর্তনের জন্য দরকার পড়াশোনা, জানার আকাঙ্ক্ষা এবং জ্ঞান অর্জন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা এসব নিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে মাতামাতি করেন, শেয়ারের বন্যা বয়ে দেন, প্রমোট করেন তারা সংশ্লিষ্ট বিষয় বা ঘটনায় অবগত না হয়েই শুধু ‘অন্যরা করছে আমিও করি’- এমন মনোভাব থেকে করে থাকেন। কিন্তু ঠিক এ মানুষগুলোকে কোনো ভালো কাজকে, ভালো বিষয়কে- যেগুলোর সঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্রের স্বার্থ ও কল্যাণ জড়িত- সেগুলোতে মাতামাতি করতে, প্রমোট করতে দেখা যায় না।

আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আমরা কোনটা নিয়ে মাতামাতি করব, কোনটা প্রমোট করব সে বোধশক্তি আমাদের নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এমন সর্বোচ্চ নেতিবাচক ব্যবহার পৃথিবীতে হয়তো আর কেউ করে না। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শিখা পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় একটি উক্তি লেখা থাকত : ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট; মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। জাতির ক্রান্তিকালে সেটাই এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close