রেজাউল করিম খোকন

  ২১ জানুয়ারি, ২০২৪

মতামত

অভিনন্দন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় কবির ভাষায় তিনি বলেছিলেন-

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়

আড়ালে তার সূর্য হাসে;

হারা শশীর হারা হাসি

অন্ধকারেই ফিরে আসে।’

বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস রুখে ফের বিপুল সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১০ জানুয়ারি সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। ১১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছে। টানা চারবার আর সব মিলিয়ে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসলেন তিনি। মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার সিরিমাভো বন্দরনায়ক, ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার বা ইসরায়েলের গোল্ডা মেয়ারকেও ছাপিয়ে গেলেন। প্রশ্নে-সংশয়ে ‘জর্জরিত’ নির্বাচনটি হেলায় উতরে দিয়েছেন বাংলাদেশের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাকে একে একে সাধুবাদ জানিয়ে গেছেন ভারত, চীন, রাশিয়া, ভুটানসহ নানা দেশের কূটনৈতিক প্রধানরা, কিছুক্ষণ পরপরই অভিনন্দনের ফোন এসেছে রাষ্ট্রপ্রধানদের। বর্তমান বিশ্বে নারীনেত্রী হিসেবে একটানা দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন থাকার ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন তিনি। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, পর্যবেক্ষকদের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি অত্যন্ত উৎফুল্ল মেজাজে। তার কথাবার্তা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, উপস্থিতিতে ছিল উচ্ছ্বাস-আনন্দ।

পরনে আসমানি ঢাকাই, মাথায় আলগা ঘোমটা, বছর ৭৬-এর প্রধানমন্ত্রী যখন তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন সবুজ ঘাসে ঢাকা লনে, তাল রাখতে পার্শ্বচরেরা দুদ্দাড়ে দৌড়াচ্ছেন। শেখ হাসিনা অনায়াসে মিশে গেলেন অপেক্ষারত ১১টি দেশের সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদের ভিড়ে। প্রত্যেকের চোখে চোখ রেখে জোড় হাতে সৌজন্য বিনিময় করলেন। বিলক্ষণ জানতেন, এই ভিড়ে মিশে রয়েছেন আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকরা। বিশ্বে নারীনেত্রী হিসেবে একটানা দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন থাকার ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ভাঙা মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়ে কেমন লাগছে- উড়ে এলো প্রথম প্রশ্ন। কপাল কুঁচকে এক লহমা ভাবলেন, তারপর বললেন- ‘মানুষ আমাকে দেশ শাসনের দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রশাসকের আবার পুরুষ-মহিলা কী!’ জানালেন, নিজেকে তিনি মহিলা প্রধানমন্ত্রী নন, শুধু প্রধানমন্ত্রী বলেই মনে করেন। তার কথায়, তবে আমি মহিলা তো বটেই। মায়ের জাত। এই বয়সে এসে দেশবাসীকে সন্তানবৎই মনে করি এবং বিনয়। একটু খাদে নামল গলা। হাসিনা বলে চললেন, ইন্দিরা গান্ধী, বন্দরনায়ক, থ্যাচাররা বড় বড় মানুষ। আমি নগণ্য, নেহাতই সাধারণ। অত লেখাপড়ার সুযোগ আমার হয়নি। তবে ছোট বয়সে বাবা-মা, তিন ভাই, দুই ভাবিকে হারিয়েছি। খুনিদের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি দেশ থেকে দেশে। গরিব মানুষের দুঃখটুকু আমি বুঝি। তিনি বলেছেন, ১৯৮৬ থেকে এ পর্যন্ত ৮ বার ভোটে লড়েছি। কখনো রক্ত ঝরিয়ে, কখনো বিনা রক্তপাতে বারবার বাংলাদেশে নির্বাচনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা গণতন্ত্রের দাবিতে লড়াই করে গিয়েছি। এবার দেখি আমাদের নিয়ে কত কথা! কোনোবার আমাদের ভোট নিয়ে অন্যদের এমন আগ্রহ দেখিনি। প্রধানমন্ত্রী জানান, সে জন্য তারা দুনিয়ার কাছে দরজা খুলে দিয়েছিলেন। যারা প্রশ্ন তুলছে, তারা এসে ভোট প্রক্রিয়া দেখে যাক। উচ্চারণ করলেন, এবার ভোটে দেশের মানুষ আমাকে নয়, গণতন্ত্রকে জিতিয়েছেন। সেনাশাসকের ঘরে জন্মানো যে দলটি (বিএনপি) ভোট বয়কট করে দেশবাসীকে গণতন্ত্র শেখাতে গিয়েছিল, মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন।

৭৫-এরপর থেকে যত নির্বাচন আমরা দেখেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে সুশৃঙ্খল এবং অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোট প- করার জন্য একটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দলের দুমাসব্যাপী ধ্বংসাত্মক ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য নির্বাচন কমিশনের ধন্যবাদ প্রাপ্য। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সব বিদেশি পর্যবেক্ষক একমত যে, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের দিন গুরুতর হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ যেকোনো নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, অতীতের যেকোনো সাধারণ নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনে হতাহতের ঘটনা তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিল। নির্বাচন যেকোনো দেশেরই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট সময়ের ভেতর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একটি মহলের দুরভিসন্ধি ছিল দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করা। ফলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে তাদের সুবিধা হয়। কোনো অশুভ শক্তি যাতে বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল না করতে পারে সে জন্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া অতীব জরুরি। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই হবেন সমগ্র দেশবাসীর নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলই সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করবে। সংসদে বিরোধী দলও তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করবে- এটাই বিধি। জাতির প্রত্যাশা, নবনির্বাচিত দলটি সরকার গঠনের পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় শতভাগ সক্রিয় ও আন্তরিক থাকবে। দেশের উন্নয়ন এবং দেশবাসীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিতে সংবিধানসম্মতভাবে যথোচিত ভূমিকা পালন করবে।

শেখ হাসিনার সরকার সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে কঠোর হস্তে দমন করেছে। উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের আধুনিক অবকাঠামোকে সমৃদ্ধ করে তুলছে। এই সরকারের হাত ধরেই বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে পারমাণবিক বিশ্বে, স্থান করে নিয়েছে মহাকাশে। বেড়েছে দেশের সমুদ্রসীমা ও ছিট মহলের সীমারেখা। উন্নয়নের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার সরকার পশ্চিমাদের ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে, বিশ্বব্যাংকের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিশ্বমানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বাস্তুহারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দানের মাধ্যমে। তৈরি হয়েছে কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল। সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ঢাকা শহরে ছুটছে স্বপ্নের মেট্রোরেল। স্বনির্ভরতার পথে বাংলাদেশের এই স্বপ্নিল অগ্রযাত্রার কাণ্ডারি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশের বিজয় মুকুটে একের পর এক অর্জনের রত্ন নিজ হাতে গ্রথিত করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। ধারাবাহিকভাবে এই সময়কালে দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জাতির পিতা মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের উপযুক্ত উত্তরসূরি হিসেবে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, দুঃসাহস ও আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিত্বের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এবারের নির্বাচনের ইশতেহারেও আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দিয়েছে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর; ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নতসমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ার কথা বলছে দলটি। শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন, অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নতসমৃদ্ধ স্মার্ট ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করবেন তিনি। গত ৪ জানুয়ারি নির্বাচনী ভাষণে তিনি বলেন, চলার পথে যদি কোনো ভুল-ভ্রান্তি করে থাকি, তাহলে আপনারা ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন- এটাই আমার আবেদন। আবার সরকার গঠন করতে পারলে, ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ পাব। আপনাদের মূল্যবান ভোটে নির্বাচিত হয়ে আরেকটিবার সরকার গঠন করতে পারলে আমাদের গৃহীত কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করে আপনাদের জীবনমান আরো উন্নত করার সুযোগ পাব। সংসদ ও রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিতের পর এখন শেখ হাসিনার সামনে দুর্নীতি রোধ এবং মানবাধিকার নিশ্চিতের বিষয়টিই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন রাজনীতির বিশ্লেষকরা। শেখ হাসিনা বরাবরই বলছেন, তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান না। বঙ্গবন্ধুকন্যার ভাষায়, তার রাজনীতি নিজের জন্য নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নেই তার এই পথচলা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশাল জয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি এবং সহিংসতার পথ পরিহার করতে হবে বিরোধী দলগুলোকে। মনে রাখতে হবে, অস্থিরতার ফলে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থবিরতা দেখা দিলে সরকারকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। কাজেই সব বিরোধী দলকে আস্থায় এনে দেশ পরিচালনা করাই নতুন সরকারের জন্য সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে। বস্তুত জাতীয় নির্বাচনে বড় বিজয় দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। বিশেষত রিজার্ভ সংকট ও মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য বড় সংকট সৃষ্টি করেছে। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে দেওয়া নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে মনে করি আমরা। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশে সর্বব্যাপী দুর্নীতি দমন করা হবে নতুন সরকারের আরেকটি বড় দায়িত্ব। বস্তুত দুর্নীতি দেশের অর্থনীতির বর্তমান নাজুক অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। দুর্নীতির লাগাম টানা না গেলে নতুন সরকারকে পদে পদে সংকটে পড়তে হবে। নতুন সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থে অবিলম্বে এসব ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে- এটাই প্রত্যাশাই করি আমরা। অভিনন্দন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, উন্নয়নের অনন্য দিশারি অদম্য এক জননেত্রী।

লেখক : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close