রেজাউল করিম খোকন

  ২৪ মে, ২০২৩

বিশ্লেষণ

মানুষের ওপর চাপ কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা

আগামী ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে বাজেট এলেই প্রতি বছরেই নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত- সবার চোখ থাকে কোথায় খরচ বাড়ল, কোথায় কমল, তা জানতে। কারণ, বাজেটের নেওয়া উদ্যোগগুলো সাধারণ মানুষের জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলে। আগামী বাজেটও তার ব্যতিক্রম নয়। বাজেটে নেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে বাড়ি-গাড়ি কেনায় যেমন খরচ বাড়তে পারে, তেমনি উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময় আয়করেও কিছুটা ছাড় থাকতে পারে। আগামী বাজেটে আপনার জন্য যেমন সুখবর থাকছে, তেমনি থাকছে দুঃসংবাদও। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে এনবিআরকে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। এজন্য অন্যান্য খাতের পাশাপাশি এনবিআরের জন্য সময় ধরে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে সংস্থাটি। এর মধ্যে আগামী অর্থবছরে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির অতিরিক্ত শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। এর পরিমাণ হবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া শুল্ক-করছাড় যৌক্তিক করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেজন্য অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর কৌশলী হতে হচ্ছে এনবিআরকে।

রাজস্ব খাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে রাজস্ব হিসেবে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। এর মধ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে। এই ঋণ বাংলাদেশ পাবে সাত কিস্তিতে তিন বছরে। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটির শর্তই হচ্ছে কর-জিডিপির অনুপাতে প্রতি বছরই সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে আইএমএফের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া গেছে। তবে শুধু আইএমএফের চাপে এসব সংস্কার না করে বরং নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতেই এই সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া আইএমএফ যে শর্ত দিয়েছে, তা কঠোর কিছু নয়। সুতরাং এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। রাজস্ব খাতের ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। এজন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। তবে সব ছাপিয়ে কর-জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।

আগামী অর্থবছর থেকে নতুন করদাতা খুঁজতে বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগ দেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এজন্য সংস্থাটি আয়কর অধ্যাদেশে নতুন একটি ধারা সংযোজন করবে বলে জানা গেছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ ঘোষণা দেওয়া হবে। বাজেটে এ ঘোষণা বাস্তবায়িত হলে নতুন করদাতা চিহ্নিত করা ও তাদের রিটার্ন দেওয়ার কাজে সহায়তা করবে বেসরকারিভাবে নিয়োগ দেওয়া এজেন্টরা। এ ছাড়া নতুন অর্থবছরে বাড়তে পারে বিদেশ ভ্রমণের খরচও। কারণ, আগামী অর্থবছরে ভ্রমণকর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। পাশাপাশি ধনীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্তরের করহারের সীমা বাড়তে পারে। তাতে ধনীদের ওপর বাড়বে কর। এভাবে মানুষের জীবনযাপনকে প্রভাবিত করবে এ রকম বেশ কিছু উদ্যোগ থাকছে আগামী বাজেটে। যার প্রভাবে কেউ পাবেন স্বস্তি, কাউকে গুনতে হবে বাড়তি কর। আবার করজালের বাইরে থাকা অনেককে আসতে হবে এনবিআরের করের আওতায়।

এখন দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৮৭ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। এর মধ্যে রিটার্ন জমা দেন মাত্র ৩০ লাখ, যা মোট জনগোষ্ঠীর পৌনে ২ শতাংশ। এখন উপজেলা এবং গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হয়েছে। তাতে উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়েও করযোগ্য আয়ের লোকজন আছেন। এমনকি শহর এলাকারও অনেক করযোগ্য মানুষকে করের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত, এনবিআর জনবলের অভাবে নতুন করদাতার সংখ্যা খুব বেশি বাড়াতে পারছে না। আগামী বাজেটে করদাতাদের চিহ্নিত করে তাদের টিআইএন দেওয়া এবং রিটার্ন দেওয়ায় সহায়তা করার জন্য বেসরকারি খাতের এজেন্ট নিয়োগের জন্য একটি ধারা আয়কর অধ্যাদেশে সংযোজনের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বেসরকারি খাতের ওই এজেন্টরা কারা করদাতা হওয়ার যোগ্য, তা চিহ্নিত করে টিআইএন নিতে সহায়তার পাশাপাশি রিটার্ন তৈরি, কর হিসাব করাসহ নানা ধরনের সহায়তাও করবেন। এমনকি অনলাইনে রিটার্ন জমাও দিয়ে দেবেন। এজন্য অবশ্য নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন পাবেন এজেন্টরা।

বর্তমানে বার্ষিক আয়ের প্রথম তিন লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো কর দিতে হয় না। এটি বাড়িয়ে ৩ লাখ ২০ হাজার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত করা হতে পারে। এ ছাড়া ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনা হলে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দাখিলের বাধ্যবাধকতায় মিলতে পারে ছাড়। বর্তমানে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে রিটার্নের প্রমাণপত্র দেখাতে হয় না। ছোট করদাতাদের জন্য ভালো খবর থাকলেও ধনীদের জন্য আগামী বাজেট হতে পারে ‘খারাপ’। কারণ, ফ্ল্যাট-প্লট, দামি গাড়ি কেনায় খরচ বাড়তে পারে। ফ্ল্যাট-প্লট, গাড়ির ওপর শুল্ক-কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। ফ্ল্যাট-প্লট নিবন্ধন করার সময় ক্রেতাকে নানা ধরনের কর দিতে হয়। যেমন গেইন ট্যাক্স, ভ্যাট, স্ট্যাম্প মাশুল, নিবন্ধন মাশুল, স্থানীয় সরকার কর। সব মিলিয়ে ১০ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ কর দিতে হয়। এই করহার বাড়ানো হতে পারে। সব মিলিয়ে করভার হতে পারে ১৫ শতাংশ। দামি গাড়ি আরো দামি হতে পারে। আগামী বাজেটে দ্বিতীয় গাড়ির অগ্রিম কর বাড়ানোর প্রস্তাব আসছে। গাড়ির ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় এই কর দিতে হয়।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। এজন্য কর আহরণের কারণে যাতে সাধারণ মানুষের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি না হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আলোকে কাজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনেই যাতে বাড়তি কর আদায় করা যায়, সেজন্য নানামুখী কৌশল নিচ্ছে এনবআির। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে- জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর যেন করের চাপ না বাড়ে। সে বিষয় নজর দিয়ে আগামী অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে করপোরেট কর কমানো বা বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব রাখছে না এনবিআর। করপোরেট কর অপরিবর্তিত থাকছে। টানা গত দুই বছর করপোরেট কর কমানো হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং স্বাস্থ্য খাতের যেসব পণ্য বা কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক-কর নেই, সেখানে হাত দেওয়া হবে না। অন্যদিকে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনার যে সুযোগ চলতি অর্থবছরে দেওয়া হয়েছে, এর মেয়াদ আর বাড়ানো হচ্ছে না। ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে আনার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ জুন। কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ এই সুযোগ নেয়নি।

ঋণনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে পর্যায়ক্রমে নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট প্রণয়ন করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে রাজস্ব আদায় বাড়াতে নতুন কৌশল নিচ্ছে সরকার। তবে যারা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, টিআইএন নিয়ে নিয়মিত ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিচ্ছেন তারা যেন হয়রানির শিকার না হন সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চলমান বৈশ্বিক সংকটের এ সময় কর হার না বাড়িয়ে কর আদায়ের আওতা বাড়ানোর দিকে নজর রয়েছে। আগামী বাজেটের সম্ভাব্য ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৬৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে এনবিআরকে সংগ্রহ করতে হবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া নন-এনবিআর কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কর-বহির্ভূত আয় (এনটিআর) চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫৪ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংস্থাকে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ বিভাগ। সে অনুযায়ী সংস্থাগুলো তাদের আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close