রাশেদ নাইব
দৃষ্টিপাত
আল্লাহর পথে ব্যয় রয়েছে পুরস্কার
যারা আল্লাহর রাস্তায় ধনসম্পদ ব্যয় করেন, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মতো; যা থেকে সাতটি শিষ জন্মায়। প্রতিটি শিষে ১০০ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ। ‘যারা স্বীয় ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে আর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করেন না এবং কষ্টও দেন না, তাদেরই জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদের কোনো আশঙ্কা নেই’- (সুরা বাকারা : ২৬১-২৬২)।
ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ; আল্লাহর পথে ব্যয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আল্লাহর পথে খরচ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। এককথায় আল্লাহ খুশি হন এমন কাজে অর্থ ব্যয় করাই হচ্ছে ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে খরচ। আল্লাহকে খুশি করার জন্য, নিজের জন্য, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, সমাজ ও মানবতার কল্যাণ এবং সর্বোপরি আল্লাহর দ্বীনের প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কাজে যে অর্থ ব্যয় হয়, সবই ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে- খরচ হতে হবে শুধু আল্লাহকে খুশি করার জন্য। খ্যাতি লাভ, প্রদর্শনে ইচ্ছা কিংবা জাগতিক কোনো স্বার্থে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কোনো কাজে অর্থ খরচ হলেও তা ইনফাক ফি সাবিল্লিাহ হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। অপরদিকে আল্লাহকে খুশি করার জন্য নিজের বা পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করা হলেও ইনফাক এর সওয়াব আল্লাহ দান করবেন বলে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।
শব্দটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা : ইনফাক শব্দটির মূল ধাতু নাফাক, যার অর্থ সুড়ঙ্গ। সাধারণত সুড়ঙ্গের একদিক দিয়ে প্রবেশ করে আরেক দিক দিয়ে বের হওয়া যায়। আর এই নাফাক শব্দটির সঙ্গে মাল শব্দটি যোগ হলে এর অর্থ হয় সম্পদ খরচ করা, শেষ করা। এর মানে হচ্ছে সম্পদ কারো হাতে কুক্ষিগত থাকার বস্তু নয়। সম্পদ একদিক দিয়ে আসবে আবার আরেকদিক দিয়ে খরচ হবে। তবে কোরআনে যে ইনফাকের কথা বলা হয়েছে, সেই ইনফাকের সঙ্গে আয় ও ব্যয়ে বৈধতার প্রশ্ন রয়েছে। অবৈধ উপায়ে আয় করে অবৈধ খাতে খরচ করলে কোরআনে বর্ণিত ইনফাক হবে না। ইনফাক হতে হলে সম্পদ বৈধভাবে আয় করতে হবে এবং আল্লাহকে খুশি করার জন্য বৈধ খাতেই ব্যয় করতে হবে।
সুতরাং দান করতে হবে সর্ব অবস্থায় : আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরই ভালোবাসেন’- (সুরা আল ইমরান : ১৩৩-১৩৪)।
প্রিয় বস্তুকে দান করতে হবে : সুরা আল ইমরানের ৯২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তোমরা প্রকৃত পুণ্য লাভ করতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলো আল্লাহর পথে ব্যয় না করবে। এসব আয়াতের দাবি পূরণের জন্য খাঁটি মুমিনগণ অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করে থাকেন। সুরা আল আহজাবের ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের ইনফাককারী পুরুষ ও ইনফাককারী মহিলা বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তারা আল্লাহর পথে অকাতরে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করেন। সমাজের অভাবী ব্যক্তিদের প্রতি তাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত হয়। আর আল্লাহর দ্বীেনর আওয়াজ বুলন্দ করার কাজে তারা উদারভাবে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে থাকেন।
প্রয়োজন বিশুদ্ধ নিয়ত : খালেস নিয়ত, দায়িত্ব মনে করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যদি দান করা হয়, তাহলে তার ব্যাপক ফজিলত রয়েছে। এসব ফজিলতের কিছুটা পার্থিব এই পৃথিবীতেও লক্ষ করা যায়, তবে বেশির ভাগ ফজিলতই পরবর্তী জীবনের পাথেয় হিসেবে জমা থাকে। এছাড়াও এ জন্য আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও পাবেন দানকারীরা। এ কারণেই দয়াময় আল্লাহ কোরআনেকারিমে দান-খয়রাতের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে দানের ব্যাপারে নিয়তের স্বচ্ছতার কথা বলেছেন।
দান করার নীতিমালা : দান করার কিছু নীতিমালা আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে ঘোষণা করেছেন। যেমন- দান করতে হবে শুধু আল্লাহতায়ালার জন্য। কাউকে দেখানোর জন্য নয়। দান-খয়রাত করে ভবিষ্যতে কোনো স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করা যাবে না। আত্মপ্রদর্শনের উদ্দেশ্য কৃত দানকে নিকৃষ্টতম দান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে ইসলামে। এ ছাড়া যাকে দান করা হলো তার কাছ থেকে এর বিনিময়ে কোনো সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করা যাবে না।
আর ইসলামের ইতিহাসের শুরু থেকেই দাওয়াতি কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইসলামের হেফাজতের জন্য আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন দেখা দিয়ে আসছে। এই জন্য স্বয়ং রাসুল (সা.) তাবুকের যুদ্ধের জন্য সাহাবিদের কাছ থেকে দান নিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় রাসুল (সা.) সাহাবিদের দান করতে উৎসাহিত করেছেন। এমনকি খেজুরের এক টুকরা দান করে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাতে
বলেছেন। ধনসম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহতায়ালা। তিনি যাকে ইচ্ছা উহা প্রদান করে থাকেন। এজন্য এ সম্পদ অর্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে তার বিধিনিষেধ মেনে চলা আবশ্যক। সৎপন্থায় সম্পদ উপার্জন ও সৎপথে উহা ব্যয় করা হলেই তার হিসাব প্রদান করা সহজ হবে।
দানে সম্পদ কমে না : অধিকাংশ মানুষ দান-খয়রাত করতে চায় না। মনে করে এতে সম্পদ কমে যাবে। তাই সম্পদ সঞ্চিত করে রাখতেই সর্বদা সচেষ্ট থাকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও খরচ করতে কৃপণতা করে। প্রকৃতপক্ষে দান-সদকা করলে সম্পদ কমে না। আবু কাবশা আল আনমারী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ্ (সা.)কে বলতে শুনেছেন, ‘সদকা করলে কোনো মানুষের সম্পদ কমে না’- (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ হচ্ছে সেই বীজের মতো; যা থেকে সাতটি শিষ জন্মায়। আর প্রতিটি শিষে ১০০টি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ সুপ্রশস্ত সুবিজ্ঞ’- (সুরা বাকারা-২৬১)।
সন্দেহ নেই ধন-সম্পদ নিজের আরামণ্ডআয়েশ এবং পরিবারের ভরণপোষণের ক্ষেত্রে ব্যয় করার অনুমতি ইসলামে আছে এবং অনাগত সন্তানদের জন্য সঞ্চিত করে রাখাও পাপের কিছু নয়। কিন্তু পাপ ও অন্যায় হচ্ছে, সম্পদে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ের ক্ষেত্রে ব্যয় না করা ও গরিব-দুঃখীর হক আদায় না করা। অভাবী মানুষের দুঃখ দূর করার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘এবং তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে। ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত (অভাবী অথচ লজ্জায় কারো কাছে হাত পাতে না) সবার হক রয়েছে’- (মাআরেজ- ২৪-২৫)।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষ বলে আমার সম্পদ! আমার সম্পদ!! অথচ তিনটি ক্ষেত্রে শুধু ব্যবহৃত সম্পদই তার। ১. যা খেয়ে শেষ করেছে, ২. যা পরিধান করে নষ্ট করেছে এবং ৩. যা দান করে জমা করেছে। আর অবশিষ্ট সম্পদ সে ছেড়ে যাবে, মানুষ তা নিয়ে যাবে’- (মুসলিম)। রাসুল (সা.) বলেন,‘ যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কোনো কিছু ব্যয় করবে তাকে সাতশত গুণ সওয়াব প্রদান করা হবে’- (আহমাদ, সনদ সহিহ)।
যে ব্যক্তি হালাল কামাই থেকে একটি খেজুর সমপরিমাণ সদকা করবে (আর আল্লাহতায়ালা তো একমাত্র হালাল বস্তুই গ্রহণ করে থাকেন) আল্লাহতায়ালা তা ডান হাতে গ্রহণ করবেন। অতঃপর তা তার কল্যাণেই বর্ধিত করবেন যেমনিভাবে তোমাদের কেউ একটি ঘোড়ার বাচ্চাকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করে বর্ধিত করে। এমনকি আল্লাহতায়ালা পরিশেষে সে খেজুর সমপরিমাণ বস্তুটিকে একটি পাহাড় সমপরিমাণ বানিয়ে দেন’- (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ১৪১০)।
শেষ কথা : দান করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে, তাহলেই কেবল আখেরাতে এর ফায়দা লাভ করা সম্ভব হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের তার পথে ব্যয় করার তওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"