আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

  ০৪ আগস্ট, ২০২২

পর্যালোচনা

বিশ্ব মানচিত্রে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব

আয়তনে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম হলেও অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব অনেক। ভূ-রাজনৈতিক কারণে মহাসাগরটির গুরুত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত মহাসাগরের উত্তরে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণে অ্যান্টার্কটিকা, পূর্বে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপ এবং অস্ট্রেলিয়া এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে আরব উপদ্বীপ এবং আফ্রিকা। মহাসাগরটির সীমান্ত জুড়ে রয়েছে এশিয়ার ১২টি এবং আফ্রিকার ১৫টি দেশ। দেশগুলোর অধিকাংশই বিশ্ব রাজনীতিতে অধিকতর প্রাসঙ্গিক এবং এদের মধ্যকার রসায়ন প্রতিনিয়ত বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করে চলছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি সাগর-আরব সাগর, লোহিত সাগর, বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর ভারত মহাসাগরে পড়েছে। এ ছাড়া এডেন উপসাগর এবং পারস্য উপসাগর ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে-জাম্বেসী নদী, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের মিলিত প্রবাহ শাত-ইল-আরব, সিন্ধু নদী, গঙ্গা নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ এবং ইরাবতী নদী। মালাক্কা প্রণালি, এডেন উপসাগরের বাব-এল-মান্দেব প্রণালি এবং পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালি বিশ্ব বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। বিশ্ব তেল সরবরাহের ৪০ শতাংশ হরমুজ প্রণালি দিয়ে, ৩৫ শতাংশ মালাক্কা প্রণালি দিয়ে এবং ৮ শতাংশ বাব-এল-মান্দেব প্রণালি দিয়ে পরিবহন করা হয়। পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ অফশোর পেট্রোলিয়াম এবং ৬০ শতাংশ তেলের মজুদ আছে এখানে। এ ছাড়া রয়েছে ৩৫ শতাংশ গ্যাস, ৪০ শতাংশ স্বর্ণ, ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম এবং ৮০ শতাংশ ডায়মন্ড। তাই সংগত কারণেই বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে ভারত মহাসাগরের ভূমিকা অপরিসীম।

ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশ ভারত বিশ্ব অর্থনীতির উদীয়মান শক্তি। ভারতের অর্থনীতির আকার দিন দিন যত বড় হচ্ছে, ততই আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আর সেখানেই ভারতের সঙ্গে বিরোধ লাগছে আরেক বিশ্ব পরাশক্তি এবং ভারতের প্রতিবেশী দেশ চীনের। এই দুই বৃহৎ শক্তি এখন ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করা নিয়ে ব্যস্ত। দেশ দুটি ভারত মহাসাগরে একের পর এক নির্মাণ করে চলেছে সামরিক ঘাঁটি, মোতায়েন করছে যুদ্ধজাহাজ। ভারত মহাসাগরের পাশর্^বর্তী অন্যান্য দেশকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে হাজির হচ্ছে নানা ধরনের আর্থিক (ঋণ) সুবিধা নিয়ে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি কথা প্রচলিত আছে- সমুদ্র নিয়ন্ত্রণে যার, বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে তার। কারণ বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৯০ ভাগই হয় সমুদ্রপথে। ১৯ শতকের একজন বিখ্যাত নৌ-কৌশলবিদ আলফ্রেড থায়ার তার ‘The Interest of America in Sea Power’ শিরোনামের বইটিতে বলেছেন, ‘সমুদ্রবাণিজ্য বা নৌশক্তি যেভাবেই হোক না কেন, সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকলে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কারণ স্থল ভূমিতে যত সম্পদই থাকুক না কেন, সমুদ্রপথে সম্পদ বিনিময় বা বাণিজ্য যত সহজ, অন্যপথে তা অত সহজ নয়।’ তিনি বলেন, একটি দেশ যদি দুনিয়ায় পরাশক্তি হতে চায়, তাহলে তাকে আশপাশের জলসীমায় প্রভুত্ব করতে হবে। অর্থনীতিতে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি। চীন এখন চাইছে বিশ্ব পরাশক্তি হতে। তাই সংগত কারণেই প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে চীন তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চাইবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীন যে তেল এবং গ্যাস আমদানি করে সেটি পারস্য উপসাগর এবং আরব সাগর হয়ে, মালাক্কা প্রণালি দিয়ে পূর্ব চীনে পৌঁছায়। তাই নিজেদের জ্বালানি সরবরাহের পথকে নির্ঝঞ্ঝাট রাখতে চীন প্রতিনিয়ত ভারত মহাসাগরে নিজেদের উপস্থিতি বাড়িয়ে চলছে। সেই লক্ষ্যে জিবুতি, কেনিয়ার মোমবাসা, পাকিস্তানের গাওদার, শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা এবং মিয়ানমারের কয়উপ্পুতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে চীন। পাকিস্তানের গাওদার বন্দর থেকে পশ্চিম চীনের কাশগড় পর্যন্ত নির্মাণ করেছে প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক করিডর। সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা তেল পরিবহনের জন্য প্রয়োজন পড়বে না মালাক্কা প্রণালির। পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালি হয়ে গাওদার বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্য সরাসরি পৌঁছে যাবে পূর্ব এশিয়ায়।

ভারত মহাসাগর জুড়ে চীনের নানা অবকাঠামোগত নির্মাণের মাঝে থেমে নেই ভারতও। মহাসাগরের তীরবর্তী ক্ষুদ্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরের বন্দরগুলো সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহারের বিষয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে ভারত। পারস্য উপসাগরীয় দেশ ওমানের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সমুদ্রসীমায় অবস্থিত দকুম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে ভারত। এ ছাড়া দ্বীপরাষ্ট্র সিসিলিস ও মরিশাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে ভারত।

ভারত-চীন ছাড়াও ভারত মহাসাগরের সীমান্তে পারস্য উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত জিসিসিভুক্ত ৬টি দেশও বিশ্বরাজনীতি এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। লোহিত সাগরের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত হর্ন অফ আফ্রিকা অঞ্চলজুড়ে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। এখান থেকেই লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে সুয়েজ খাল দিলে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করতে হয়। তাই চীন ভারত ছাড়াও অঞ্চলটির গুরুত্ব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার কাছে। তাই কেউই চাইবে না এখানে শক্তির কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হোক।

পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইরান, ইসরায়েল, মিসর, কাতার এমন আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশের স্বার্থ রয়েছে ভারত মহাসাগরে। তাই বলাই যায়, স্বাভাবিকভাবেই সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল ধারাটি প্রবাহিত হবে ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে। ভারত মহাসাগরের নীল ঢেউগুলো আন্দোলিত হবে যুদ্ধজাহাজের মহড়ায়। কোন শক্তি সেখানে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করবে- সেটিই এখন দেখার বিষয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close