রেজাউল করিম খোকন

  ১৩ জানুয়ারি, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়

দেশের প্রত্যন্ত এলাকা, গ্রামে বসবাসকারী তরুণ-তরুণীরাও আজকাল লেখাপড়ার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে ইউরোপণ্ডআমেরিকা থেকে হাজার হাজার ডলার আয় করছেন, যা একদশক আগেও কল্পনা করতে পারেননি তারা। সাধারণ অসচ্ছল দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা সরকারের আইসিটি বিভাগ থেকে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ফ্রি প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজে নিয়োজিত হতে পারছেন। মাত্র ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা কাজে নেমে পড়ছেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি এখন তারা প্রতি মাসে কমপক্ষে তিন থেকে চার শ ডলার উপার্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন। এর মাধ্যমে দরিদ্র অসচ্ছল পরিবারগুলোতে সচ্ছলতা আসছে, স্বাচ্ছন্দ্যের ছোঁয়া লেগেছে। গ্রামীণ জীবনে নতুন গতির সঞ্চার করেছে এসব উদ্যমী তরুণ-তরুণীর ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করেন। নির্বাচনে জয়ের পর ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের তত্ত্বাবধানে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রোডম্যাপ চূড়ান্ত করা হয়। তখন থেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশের দিনবদলের যাত্রা শুরু। সেই যাত্রার শেষপর্যায়ে পৌঁছে আজ বাংলাদেশ নতুন এক অবস্থানে রয়েছে। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনযাপন, ভাগ্য, কর্মকাণ্ড, চিন্তাভাবনা ও স্বপ্ন। শুধু আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দেশের লাখ লাখ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের সুবাদে দেশের রেমিট্যান্স দিনে দিনে ক্রমেই বাড়ছে। প্রবাসে কর্মরত এক কোটি বাংলাদেশির সঙ্গে দেশের রেমিট্যান্সকে আরো বাড়িয়ে নিতে দেশে অবস্থান করেও রেমিট্যান্স যুদ্ধে নেমেছেন লাখ লাখ তরুণ। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করে অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে তারা আনছেন তাদের অর্জিত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। এই খাতে এখন ঘটে চলেছে নীরব বিপ্লব।

এখন প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল সেবা প্রদানের জন্য বিভিন্ন সেন্টার। যেখান থেকে মানুষ বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল সেবা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সেখানে ডিজিটালবিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে যোগ্য, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ হয়ে এ লাইনের পেশায় যুক্ত হতে পারছেন লাখ লাখ তরুণ-তরুণী। এখন আর শুধু বেসরকারি সেবা নয়, সরকারি সব সেবাও মিলছে অনলাইনে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হতো যে কাজে সেই জমির পর্চাও মিলছে অনলাইনে। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ই-নামজারি, পাসপোর্টের জন্য আবেদন থেকে শুরু করে সবকিছুই মিলছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে। ঢাকার বাইরে ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্যাল কেবল দিয়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল সেন্টার। সেখানে ২৭০টিও বেশি সেবা পাওয়া যাচ্ছে। দেশে স্থানীয় সরকার কাঠামোর সবচেয়ে প্রান্তিক একক ইউনিয়ন পরিষদ। ২০০৯ সালে ১০০টি ইউনিয়ন পরিষদ দিয়ে শুরু হয়ে ১২ বছর পর সারা দেশে এখন সাড়ে চার হাজারেরও বেশি ইউনিয়নের প্রায় সব কটিতেই ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। এর প্রতিটিতে একজন নারী ও একজন পুরুষ উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা ডিজিটাল সেবার আওতা বাড়িয়ে দিচ্ছেন প্রান্তিক মানুষের কাছে।

সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারে সুযোগ করে দেওয়াটা বর্তমান সরকারের বিরাট সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যদি ঢাকার বাইরে ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক্যাল কেবল না যেত, তাহলে এই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ১২ কোটিতে পৌঁছাত না। যে ইউনিয়নে বিদ্যুৎ ছিল না, সোলার বিদ্যুতের মাধ্যমে সেখানেও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেগুলোর সুফল সাধারণ জনগণ পাচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষও এখন ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এসেছে। দুর্গম, পার্বত্য এলাকা, হাওর, দ্বীপ এলাকা- কোনো কিছুই আর এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না কোনোভাবেই।

ডিজিটাল বাংলাদেশ যুগে প্রবেশের কারণে আমাদের জীবনযাপন অনেকটা পাল্টে গেছে। আজকাল ব্যাংকের শাখায় না গিয়েও চেক উপস্থাপন না করে টাকা তোলা যাচ্ছে এটিএম বুথ থেকে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে দ্রুত এবং খুব কম সময়ে বিভিন্নজনের কাছে টাকা পাঠানোর অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়ে। আগে ব্যাংকে গিয়ে টিটি কিংবা ডিডি অথবা পে-অর্ডার ইস্যুর মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হতো। সেখানে সময় লেগে যেত অনেক প্রাপকের কাছে টাকা পৌঁছাতে। দেশে বর্তমানে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়েছে। দৈনিক মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি টাকা। ই-টেন্ডার ব্যবস্থা চালুর ফলে সরকারি ক্রয় এবং এ-সংক্রান্ত কাজে স্বচ্ছতাণ্ডজবাবদিহি নিশ্চিত হয়েছে। এখন প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে টেন্ডার ছিনিয়ে নেওয়া কিংবা জোর করে সরকারি কাজ পাওয়ার দিন শেষ হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে অতীতের চিঠিপত্র পাঠানোর প্রক্রিয়ার বদলে ই-মেইল ব্যবহারের চল শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে খুব কম সময়ে প্রাপকের ইমেইল ঠিকানায় পত্র, সার্কুলার, দপ্তর স্মারক ইত্যাদি পাঠাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন কর্মকর্তারা। এটা ১০ বছর আগেও ভাবতে পারতেন না তারা।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্য দিনবদলের উপাখ্যান ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন উপস্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। সেই স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়, দেশের সব মানুষের কাছে বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০০ রকমের সরকারি-বেসরকারি সেবা এসব সেন্টারের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় দেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে বর্তমানে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ডিজিটাল সেন্টারে ২৭০টির বেশি সেবা দেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জমির পর্চা, নামজারি, ই-নামজারি, পাসপোর্টের আবেদন ও ফি জমাদান, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিক সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, হজ রেজিস্ট্রেশন, সরকারি সেবার ফরম, টেলিমেডিসিন, জীবন বিমা, বিদেশে চাকরির আবেদন, এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, বাস-বিমান, ট্রেন, লঞ্চ টিকিটিং, মেডিকেল, ভিসা, চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, মোবাইল রিচার্জ, সিম বিক্রয়, বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ, ই-মেইল, কম্পোজ-প্রিন্ট-প্রশিক্ষণ, ছবি তোলা, ফটোকপি, সরকারি ফরম ডাউনলোড করা, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল জানা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করা, অনলাইন ভিসার আবেদন করা, কৃষি পরামর্শ, তথ্য সেবাসহ নানা ধরনের সেবা। এই ডিজিটাল সেন্টারগুলোতে একজন উদ্যোক্তা সেবা দেওয়ার মাধ্যমে মাসে ৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারছেন। গড়ে প্রতি মাসে ডিজিটাল সেন্টারগুলো থেকে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ সেবা গ্রহণ করছেন।

ডিজিটাল বাংলাদেশের চমকপ্রদ উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে দেশে সামগ্রিক আর্থিক লেনদেন কার্যক্রমে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পর্যন্ত আর্থিক লেনদেন নতুন এক বিপ্লব ঘটেছে। প্রান্তিক মানুষও এখন ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে স্বাচ্ছন্দ্য ও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। মূলত বিকাশের হাত ধরে ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনের সূচনা ঘটলেও প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়নের কাণ্ডারি শেখ হাসিনার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সুবিধা গ্রামের প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে গেছে ডাক বিভাগের ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদ। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষের কাছে সরকারি বিভিন্ন আর্থিক সেবা পৌঁছে দিচ্ছে তারা। এটা আজ সবাই উপলব্ধি করেছেন আর্থিক খাতে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে এরই মধ্যে অনেকটাই সফল বাংলাদেশ। আগে বয়স্ক, বিধবা, অসচ্ছল, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হতো দূরবর্তী উপজেলা বা জেলা সদরে গিয়ে ব্যাংক থেকে সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভাতা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। সাধারণ দুস্থ, দরিদ্র-অসহায় মানুষগুলোর সেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের অবসান ঘটেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের জাদু সব কষ্ট-দুর্ভোগ এক নিমিষেই দূর করে দিয়েছে তাদের। এখন ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা তাদের ভাতার টাকা পেয়ে যাচ্ছেন দ্রুত এবং ঝামেলাবিহীন।

মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস মানে এমএফএস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুণ এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে বলা যায়। দেশের বর্তমান এমএফএসে অ্যাকাউন্ট প্রায় ১২ কোটি। এর মধ্যে সক্রিয় অ্যাকাউন্টের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। বিকাশের মাধ্যমে খোলা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছয় কোটির মতো, আর নগদের অ্যাকাউন্ট সাড়ে পাঁচ কোটি। রকেটের মাধ্যমেও খোলা অ্যাকাউন্টের সংখ্যা আড়াই কোটির মতো। তবে একজন মানুষ একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারও করছেন। দেশের সব মানুষের হাতে এই সেবা পৌঁছে দিতে সরকার বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন হাতে হাতে নগদ লেনদেনের বদলে নগদবিহীন আর্থিক লেনদেনের অর্থাৎ ক্যাশলেস সোসাইটির কথা ভাবছে। নগদ লেনদেনের ঝুঁকি ঝামেলা ও বিড়ম্বনা এড়াতে ডিজিটাল মানি ট্রান্সফারে ঝুঁকে পড়ছেন দেশের মানুষ। এটা ডিজিটাল বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক প্রকাশ। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল শহরে কেন্দ্রীভূত নেই এখন। গ্রামের সাধারণ মানুষও এর সুফল পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার শেখ হাসিনা যখন ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করেছিলেন তখন অনেকেই এটা অবাস্তব অসম্ভব অলীক কল্পনা বলে বিদ্রƒপ করেছিলেন। তার অসাধারণ প্রজ্ঞা, বিচক্ষণ, দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল রূপ লাভ করেছে। শেখ হাসিনার দেখানো সেই স্বপ্ন এখন আমাদের কাছে বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। যার সুফল ভোগ করছে দেশের আপামর সব জনগণ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close