কে এম মাসুম বিল্লাহ

  ৩১ জুলাই, ২০২০

মুক্তমত

কৃষিবিদদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ বিসিএস

করোনার কারণে থমকে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি, বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার কারণে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্যমতে, ১৯৩০ সালের পর এই প্রথম বিশ্ব বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত যে, করোনা-পরবর্তী বিশ্ব আর্থিক মন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, যেখানে উৎপাদন ব্যবস্থাও আছে হুমকির মুখে। করোনা পরবর্তী বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ হতে যাচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে বিন্দু পরিমাণ জমিও অনাবাদি না থাকে। এই ঘোষণার মাধ্যমেই বোঝা যায়, করোনা-পরবর্তী সময়ে কৃষি কতটা গুরুত্ব বহন করছে।

করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় ১৩ লাখ প্রবাসী দেশে এসেছেন, যাদের অনেকেই শ্রমিক। এদের অনেকেই কাজ হারানোর শঙ্কায় আছেন। দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কথা উঠেছে, লকডাউনের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও আছেন আর্থিক সংকটে, শহরের খেটে খাওয়া মানুষগুলো শহর ছেড়ে গ্রামে আসা শুরু করেছে বিকল্প কর্মসংস্থানের খোঁজে। সেক্ষেত্রে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা আমাদের মতো জনবহুল দেশের জন্য হতে পারে আরো বড় চ্যালেঞ্জ। বিকল্প কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কৃষিই হতে পারে একমাত্র আশাব্যঞ্জক খাত। উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য করোনা-পরবর্তী সময়ে আমাদের ঝুঁকতে হবে কৃষি খাতের দিকেই। আর স্বাভাবিকভাবেই তাই কৃষি খাতে দরকার বাড়তি নজরদারি।

কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে এই খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনারও ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এ ছাড়াও ৪ শতাংশ সুদে কৃষকদের ঋণ প্রদান, ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি, ৮৬০ কোটি টাকার বোরো শস্য ক্রয় ও ১৫০ কোটি টাকার বীজ প্রদান করার হচ্ছে; যার মাধ্যমে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি চাকরি হারানোর শঙ্কায় থাকা বিপুল শ্রমশক্তিকে কৃষিতে নিয়োজিত করতে পারলে সংকট কিছুটা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এই প্রণোদনার সুফল ইতোমধ্যেই কৃষকরা পাওয়া শুরু করেছেন, তবে সবকিছুর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এ ছাড়াও সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা ও পোস্ট হারভেস্ট ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্যও দরকার পরিকল্পনা, যা করোনা-পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ বর্তমানে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, গত ৩০ বছরে দ্বিগুণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কৃষির ওপর জোর দেওয়ায় কৃষিতে অনেক সাফল্য এসেছে আমাদের দেশে, যা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সাহায্য করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের দেশে ব্যাপক ফসলহানি হয় প্রতি বছর। খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততাসহ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। এর পরও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান বিশ্বে ১০ম। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাল ও মাছ উৎপাদনে চতুর্থ। বিপুল জনসংখ্যা ও স্বল্প জমি নিয়ে এমন সাফল্যের পেছনে আছে কৃষিবিদদের অবদান। ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবনে সারা বিশ্বে প্রথম স্থানে আছে বাংলাদেশ, এমন বাস্তবতায় কৃষিবিদদের অবদান অনস্বীকার্য। বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে খাপখাওয়াতে পারে এমন জাত তৈরি করছে কৃষি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ এসব সেক্টরের সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

করোনা-পরবর্তী খাদ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের জন্য কৃষি ক্ষেত্রে দরকার সামগ্রিক পরিকল্পনা। কৃষির উৎপাদন, সঠিক পরিকল্পনা, উদ্যোক্তা তৈরি, বিপণন ব্যবস্থা সর্বোপরি এসব কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজন হবে কৃষিবিদদের। কৃষিকে এগিয়ে নিতে সরকারিভাবে প্রচুর কৃষিবিদ নিয়োগ দরকার, প্রয়োজনে স্বাস্থ্য ক্যাডারে বিশেষ নিয়োগের মতো বিশেষ বিসিএসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিভিন্ন কৃষি সম্পর্কিত সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এসব কৃষিবিদের নিয়োগ প্রদান করে নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে উন্নত ফসলের জাত বের করতে হবে, এ ছাড়াও বিশেষ বিসিসের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা ও মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সহযোগিতার জন্য প্রতি উপজেলায় নতুন করে আরো কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। যাতে করে আগামী দিনের খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।

বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ২৩ কোটি টাকা এবং বর্তমান ২০২০-২১ অর্থবছরে যার পরিমাণ ২৯ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা, যা মূল বাজেটের কেবল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছরের বাজেটের তুলনায় খুব বেশি বরাদ্দ রাখা হয়নি। তবে করোনা-পরবর্তী কৃষি খাতের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে আরো কিছু বরাদ্দ রাখা দরকার ছিল। বিভিন্ন কৃষি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি সম্পর্কিত অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত অনুদান প্রদানের মাধ্যমে আরো নতুন নতুন উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে।

কৃষিবিদদেরও প্রণোদনার আওয়াতাভুক্ত করা যেতে পারে। কৃষি নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি ও এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সরকারের নজরদারি ও প্রয়োজনে আর্থিক প্রনোদনা দেওয়া দরকার। সামগ্রিক এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে কৃষির উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

করোনার ভ্যাকসিন পুরোপুরিভাবে বাজারে না আসা পর্যন্ত হিউম্যান ইমিউনিটির ওপর জোর দিতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। হার্ড ইমিউনিটির জন্য প্রয়োজন সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ, পাশাপাশি প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার। সেক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা নিতে পারলে শাকসবজি ফলমূল উৎপাদন নিশ্চিতের পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করারও সুযোগ আসবে; যা খুলে দিতে পারে অর্থনীতির নতুন দুয়ার। আর এসব ব্যবস্থায় কৃষিবিদরাই রাখতে পারে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই সব দিক বিবেচনায় নতুন করে কৃষিবিদ নিয়োগ কিংবা কৃষিবিদদের জন্য বিশেষ বিসিএসের ব্যবস্থা হতে পারে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।

লেখক : কৃষিবিদ, কলামিস্ট

ও ব্যাংক কর্মকর্তা (সুপারিশপ্রাপ্ত)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close