আবু আফজাল সালেহ

  ৩১ জুলাই, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

করোনাকালের বন্যা নদীভাঙন ও ঈদ

এমনিতেই কোভিড-১৯ ছোবলে কাঁপছে দেশ। উন্নত বিশ্ব নামে পরিচিত দেশগুলোও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। এই করোনা মহামারিকালেই আবার বন্যা। উত্তরবঙ্গসহ দেশের অনেকাংশে বন্যার প্রাদুর্ভাব। নদীর পানি বাড়ছে। পানি কমতে থাকলে নদীভাঙন ত্বরান্বিত হবে। এমনিতেই নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভাঙন একটি দুর্যোগ। মেঘনা-পদ্মা-যমুনার অনেক তীরবর্তী অঞ্চলের চিত্র প্রতি বছরই পাল্টে যায়। যেহেতু প্রায় সব নদীতে পানি বাড়ছে, তাই নদীভাঙনে এবার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হতে পারে। এখনই আমাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করে আন্তরিকতার সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প/কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নেও আন্তরিক হতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে অধিক আন্তরিক হয়ে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। উল্লিখিত দুই দুর্যোগের মধ্যেই পবিত্র ঈদুল আজহা। খোলা মাঠে নামাজ আদায় না করার নির্দেশনা আছে। কোরবানি পশু ক্রয় ও কোরবানি প্রক্রিয়া করার ক্ষেত্রে কঠোর নির্দেশাবলি ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। অনলাইনে কোরবানি পশু ক্রয়ের এমন ধারণা আমরা প্রথম পেলাম। শিক্ষাক্ষেত্রেও অনলাইনই ভরসা। এমন ঈদ বিশ্ববাসী আগে দেখেনি। করোনা মহামারি নতুন করে অনেক কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে। প্রতি ঈদের আগে-পরে অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এবার অবশ্য কর্মস্থল ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তার পরও অনেক শহরবাসী গ্রামের বাড়িতে ছুটবেন। করোনা বিস্তার হওয়ার ভয় থেকেই যাচ্ছে। আমরা এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। করোনার পাশাপাশি বন্যা ও নদীভাঙন ঈদ আনন্দে ঘাটতি হবেই।

পানিস¤পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩০ জেলায় নদীভাঙন ঠেকানোর কাজ চলছে। চলমান বন্যায় সবচেয়ে বেশি ভাঙনের মুখে আছে ১২ জেলা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভাঙছে পদ্মা পাড়ের জেলা শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ ও ফরিদপুর। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েও ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে ভবন, বাজার, বসতভিটা, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যায় এ পর্যন্ত ৩৩৪টি উপজেলার ৬৬ শতাংশে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৫৪টি ইউনিয়নে ২ থেকে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৫৪টি নদী আছে। এরমধ্যে প্রধান নদীগুলো হলো পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীগুলোই সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার হয়। দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী যমুনা। এ ছাড়া তিস্তা, ধরলা, আত্রাই, কুশিয়ারা, খোয়াই, সুরমা, সাংগু, গোমতী, মাতামুহুরী, মধুমতী, বিশখালী ইত্যাদি ভাঙনপ্রবণ নদী। নদীভাঙন এ দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে যেকোনো দুর্যোগের চেয়ে বেশি মাত্রায় ধ্বংস করছে। নদীভাঙনকে অনেকে বলে থাকেন-Slwo and Silent killer-Disaster। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি বা চিন্তাভাবনা খুব কম। প্রতি বছর দেশের কিছু অঞ্চলে বন্যা হয়। নদীভাঙনে নিঃস্ব হন অনেকে। ভিটেমাটি ছাড়া হন অনেকে। সিকস্তি ও পয়স্তি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলেও ক্ষতির মাত্রা আমরা একেবারেই কম করতে পারেনি। যমুনা ও খরস্রোতা নদীর ভাঙনে প্রতি বছর আমরা অসহায়ই হই। রাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস’ (সিইজিআইএস)-এর তথ্যমতে, প্রতি বছর ভাঙনে নদীতে চলে যায় প্রায় চার হাজার হেক্টর জমি। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লাখখানেক পরিবার। সবকিছু হারিয়ে নানা ধরনের দুর্দশার মুখোমুখি হয় তারা। তবে এবার বন্যার পানি বেশি এলাকায় বিস্তৃতি হওয়ায় ও একইসঙ্গে মহামারি দুর্যোগ চলতে থাকায় কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে ধরে নিয়ে নদীভাঙন মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ‘উন্নয়ন অন্বেষণের এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এদের আবার বেশির ভাগই পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে শহর অভিমুখে ছুটছে। সত্তর ও আশির দশক থেকে এ দেশে নদীভাঙনের তীব্রতা যেমন বেড়েছে; তেমনি বেড়েছে ক্ষয়ক্ষতি। প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে আট হাজার ৭০০ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়। যার বেশির ভাগ কৃষিজমি। ক্ষতিগ্রস্ত অর্ধেক লোকেরই টাকার অভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করা সম্ভব হয় না। তারা হয় গৃহহীন, ছিন্নমূল। এরা সাধারণত বাঁধ, রাস্তা, পরিত্যক্ত রেল সড়ক, খাসচর, খাসজমিতে অবস্থান নেন। অনেকেই আবার কাজের খোঁজে আসেন শহরে।

নদীভাঙনের কারণে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক ও পারিবারিক সংকট, বাড়ছে বেকারত্ব। উন্নয়ন অন্বেষণের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ভূমিহীনদের ৫০ শতাংশই নদীভাঙনের শিকার। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, নদীভাঙনের কারণে এক ব্যক্তির জীবনে গড়ে ২২ বার ঠিকানা বদল করতে হয়। স্বাধীনতার পর থেকে নদীভাঙনে এ দেশের পৌনে দুই লাখ হেক্টরের মতো জমি বিলীন হয়েছে বলে

বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমেই সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় যমুনা নদীর ভাঙনে লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাথমিক সহায়তায় এগিয়ে আসে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু কিছুদিন পরে এসব অসহায় মানুষকে নিজের পথ বেছে নিতে হয়। নদীভাঙনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যা সমাজ জীবনের ওপর প্রভাব পড়ছে। এর ফলে গতকালের আমির আজ ফকির ও আশ্রয়হীন হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ অভাবের তাড়নায় কিংবা অন্যের চাপের মুখে অবশিষ্ট জমিজমা, গবাদিপশু এবং মূল্যবানসামগ্রী হাতছাড়া করে ফেলে। অনেক পরিবার অতিমাত্রায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে পতিত হয়ে থাকে। খাবার পানি ও পয়ঃপরিচ্ছন্নতার তীব্র সংকট দেখা দেয়। নারীদের ব্যক্তিগত বা দৈহিক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয় এবং নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। বহুসংখ্যক লোক কর্মসংস্থান লাভের বা বেঁচে থাকার আশায় এলাকা ত্যাগ করে শহর বা অন্য কোনো স্থানে অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়ে চলে যায়। অনেকে বস্তিতে বসবাস করছে। বর্তমানে করোনা মহামারি চলছে। এতে শহর থেকে গ্রামের দিকেই চলে যাচ্ছে। অনেকে কর্মসংস্থান হারিয়ে শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। ফলে নদীভাঙনে সৃষ্ট এমন সমস্যা বড় হয়ে যেতে পারে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে অনেকের পড়াশোনার বিঘœ হয় বা অনেকের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। শত শত বা হাজার হাজার মানুষ বাঁধ বা শহরের বস্তিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুরা বাঁধ বা বস্তির জীবনে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে পুষ্টিহীনতার প্রসার ঘটায়। শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের সামাজিক অবস্থানের চরম অবনতি ঘটে। নদীতে ভেঙে যাওয়া জমি জেগে উঠলে তা দখলের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়, কোন্দল-মামলা বাড়ে। অনেক ক্ষেত্রে রক্তপাত হয়।

পলিমাটি গঠনের জন্য বাংলাদেশের নদীভাঙনের কারণ। বর্ষাকালে নদীর প্রবাহের বিস্তৃতি অনেক বেশি থাকে। বর্ষা শেষে নদীর স্রোত ও পরিধি অনেক কমে যায়। এতে দুকূলে ভাঙন হয়। অনেক স্থানে নদীর দুকূলে স্থাপনা থাকে। এতে নদীর গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে নদীপাড়ে শক্তভাবে পাড় দেওয়া হয় না। নদীপথ শেষের দিকে স্রোতের বেগ কম থাকে। কিন্তু বর্ষাকালে নদীর দুকূল স্রোতের জলে নরম হয়ে যায়। পরে সেখানে ভাঙন সৃষ্টি হয়। অনেক সময় দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নদীশাসন বা সরকারি-বেসরকারি বরাদ্দ যথাযথ ব্যবহার হয় না। তাই নদীশাসন কাজে ফাঁকফোকর থেকে যায়। বর্ষা শেষে ভাঙনের প্রকোপ কিছুটা কমলেও সারা বছর জুড়ে তা কমবেশি মাত্রায় চলতে থাকে। প্রাকৃতিক খেলা আমাদের পক্ষে বন্ধ করা কঠিন। কিন্তু আমরা, মানুষ, যেসব কারণ সৃষ্টি করেছি, সেগুলো যদি রোধ করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে নদীভাঙনের ক্ষতি রোধ সম্ভব হবে। নদীর পাড়ের ঘাস, ঝোপঝাড়, কাশবনসহ অন্যান্য বন উজাড় করে ফেললে মাটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পানির তোড়ে ভাঙন সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে নদী খনন বা ড্রেজিংয়ের কারণে ক্ষতির শিকার হয় নদী। বাংলাদেশে নদীভাঙন প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় এর পূর্বাভাস এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া গেলে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

নদীভাঙন এলাকায় সরকারের নজর আছে। তবে আরো বরাদ্দ বেশি দেওয়া যেতে পারে। বিদেশি অনেক সাহায্য সংস্থা অপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। দেশি অনেক সংস্থাও এ রকম করে। সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে নদীভাঙন ও পরবর্তী ব্যবস্থাপনা করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। এতে সুষ্ঠু-বণ্টন হতে সহয়তা করবে। নদীতে চর জেগে উঠলে ভাঙনের শিকার/ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সুষম বণ্টন করা দরকার। এ ব্যাপারে প্রশাসন কঠোরতা অবলম্বন করতে পারে। ছোট আকারের নদীগুলোর ভাঙন ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ কিছুটা সক্ষম হলেও প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি বরাদ্দের অভাবে বড় নদীর ক্ষেত্রে উদ্যোগগুলো তেমন সফল হচ্ছে না। এ ব্যাপারে আমরা সমন্বিত পরিকল্পনা করে স্বল্প বরাদ্দ সদ্ব্যবহার করতে পারি।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close