এস এম মুকুল

  ১১ জুলাই, ২০২০

নিবন্ধ

জিতে যাওয়াই সফলতা নয়

জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবই খুব সাধারণ, যেমনÑ সুখ, স্বপ্ন, হাসিখুশি থাকা, পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখা, ভালো বন্ধুর সাহচর্য, বিশ্বস্ত দাম্পত্য জীবন, প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদি। টাকা দিয়ে বাড়ি, গাড়ির সব চাকচিক্যময় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলেও জীবনের জন্য সাধারণ বিষয়গুলোই টাকায় মেলে না। অথচ মানুষ হন্যে হয়ে টাকার পেছনেই ছুটে। টাকা উপার্জন করাটাই জীবনের একমাত্র সাফল্য মনে করে। এক জীবনে সুখের সন্ধান করতে করতে টাকার পেছনে দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পরিশেষে সেই টাকা খরচ করতে হয় অসুখের পেছনে। আমরা জানি, সুস্থতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত আর কিছুতে নেই। এখন ঘরে ঘরে মানুষের ডায়াবেটিস, প্রেসার, আলসার, ক্যানসারের মতো ভয়াবহ অসুখের ছড়াছড়ি। টাকার অভাব নেই, খাবারের অভাব নেইÑ সব থাকার পরও খাবারের ক্ষেত্রে কত-শত বিধিনিষেধ। কারণ টাকা দিয়ে সুখ কেনা সম্ভব নয়। আর সে কারণেই টাকা উপার্জন করাটাই জীবনের সফলতা নয়। এ বিষয়ে ডেল কার্নেগি খুব সহজ করেই বলেছেন, সাফল্য হলো আপনি যা চান তা হাসিল করা। সুখ হলো আপনি যা চান তা পাওয়া।

১৮৩৫ সালের ২৫ নভেম্বর স্কটল্যান্ডের এক সামান্য পল্লী গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হয়। জীবনের প্রথম ১৩ বছর স্কটল্যান্ডে কাটে পরিবারের সঙ্গে। পরবর্তীতে জীবিকার তাগিদে তার বাবা সপরিবারে আমেরিকা পাড়ি জমান। আমেরিকায় তাদের ঠিকানা হয় একটি বস্তি। তখন মাত্র ১৩ বছর বয়স কার্নেগির। নোংরা আর ছেঁড়া ছিল পোশাক-আশাক। এক দিন খেলার জন্য একটি পাবলিক পার্কে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। পার্কটি ধনীদের বিশ্রামের জন্য উন্মুক্ত, এমন নোংরা বস্তিবাসীর জন্য নয়। তাই পার্কের দারোয়ান তাকে গেটেই আটকে দিলেন। সেদিন কার্নেগি অনেক অনুনয় করলেও পার্কে প্রবেশের অনুমতি পায়নি। মনে অনেক কষ্ট পেয়ে তেজোদ্দীপ্ত বালক কার্নেগি দারোয়ানকে বলল, এক দিন এই পার্ক কিনেই তবে সে পার্কের ভেতরে ঢুকবে। সেই থেকে মনে জেদ হলো তার। পার্ক কিনে ফেলতে অনেক টাকা চাই। তাই একটি সুতার কলে মাসে সাড়ে ১২ টাকা বেতনে তাঁতের মজুর হিসেবে যোগ দিল। এটাই তার জীবনের প্রথম রোজগার। তবে কার্নেগি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল বড় কোনো কাজ না মিললেও ছোট কোনো কিছু দিয়েই শুরু করতে হবে। তারপর অনেক চেষ্টায় কার্নেগি টেলিগ্রাফ অফিসে পিয়নের কাজ পেল। ভাবতেও বিস্ময় লাগে, পিয়নের কাজ করে নিজ মেধা দিয়ে টেলিগ্রাফের বিভিন্ন নিয়মকানুন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে এক দিন সে টেলিবিভাগের বড় সাহেব হয়েছিল। সাড়ে ১২ টাকা বেতনে তাঁতের মজুর থেকে অ্যান্ডব্রু কার্নেগি একসময়ের অন্যতম মার্কিন ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হতে পেরেছিল। মানুষ চাইলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। অ্যান্ডব্রু কার্নেগির জীবনের যেখান থেকে শুরু, সেখানে দাঁড়িয়ে ধনকুবের হওয়ার স্বপ্নটা শুধুই সাদামাটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু চাওয়ার কমতি ছিল না কার্নেগির। সেই চাওয়াটা আর কিছু নয়, অনেক অনেক অর্থ রোজগার করা। এই ধনী হওয়ার ইচ্ছাটা তার ছোটবেলার। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে সে ঠিকই একটি পার্কের মালিক হতে পেরেছিল এবং সে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।

জীবন সমস্যার ঊর্ধ্বে কোনো কিছু নয়। জীবনে বাধাবিপত্তি, সমস্যা ও সুযোগ আসবেই। জীবনের সমস্যার সমাধান সম্পর্কে আইনস্টাইনের বক্তব্যটি অসাধারণÑ ‘We cannot solve our problems with the same thinking we used when we created them.’ অর্থাৎ ‘যে চিন্তা করে আমরা সমস্যা তৈরি করেছি, সেই একই চিন্তার মধ্যে থেকে সমস্যাটির সমাধান করা যাবে না। প্রথমে সমস্যাকে ধৈর্য ও বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলা করার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। তারপর সমস্যাটির কারণ জানতে হবে। নিজের কোনো ভুল থাকলে চিহ্নিত করতে হবে। অপরের শত্রুতা বুঝতে পারলে তার দুর্বলতাগুলোও জানতে হবে। সমস্যাটি সমাধানের জন্য অবশ্যই একটি পরিকল্পনায় সাজাতে হবে। একবারেও সমাধান হতে পারে, আবার ধাপে ধাপেও হতে পারে। চেষ্টায় সমস্যার সমাধান বা যেকোনো ক্ষেত্রে সফলতা না এলেও হতাশ হওয়া যাবে না। ব্যর্থ হলে আবারও চেষ্টা করতে হবে। প্রতিটি ব্যর্থতা হলো একেকটি অভিজ্ঞতার ভান্ডো। আর অভিজ্ঞতাগুলোই সফলতার পথে একেকটা সিঁড়ি। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আত্মবিশ্বাস একটা মহাশক্তি।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম প্রায়ই বলতেন, ফেল করেছেন মানে সব শেষ হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। বরং নিজেকে প্রমাণ করার আরেকটি সুযোগ পেয়েছেন। এ ভাবনার নাম ইতিবাচক ভাবনা। আমাদের জীবনে একটা সমস্যা শেষ হতে না হতেই আরেকটি সমস্যার উৎপত্তি ঘটে। তাই সমস্যার ওপর ভর করেই সামনে এগোতে হবে। জাপানে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়। তাই বলে তারা কিন্তু দেশ ছেড়ে চলে যায়নি। বরং ভূমিকম্পসহিষ্ণু বাড়ি বানিয়ে তারা নিশ্চিতে বসবাস করছে। তাই সমস্যার ওপরই ভর করে সমাধান করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, এমন কোনো সমস্যাই নেই, যার সমাধান করা অসম্ভব।

সাফল্যের জন্য সেভেন-পি একটি অভিনব ধারণা। সেভেন পি হলোÑ ১. ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা- Positivity, ২. ভালো লাগার কাজগুলো ভালোবেসে করা- Passion, ৩. কঠোর অধ্যবসায়ে নিমগ্ন থাকা- Perseverance, ৪. লেগে থাকার মানসিকতা- Persistence, ৫. উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাওয়া- Purpose, ৬. ধৈর্যধারণ করে কাজ করা- Patience, ৭. মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা- চবড়ঢ়ষব। জীবনে সফলতা সম্পর্কে নেপোলিয়ন হিল বলেছেন, আপনার দর্শন ও স্বপ্নকে নিজের সন্তানের মতো লালন করুন, কারণ এগুলোই আপনার চূড়ান্ত অর্জনের প্রতিচিত্র হয়ে উঠবে। আবার ব্রায়ান ট্র্যাসির মতে, ‘সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো আমরা যা ভয় পাই, সেগুলো অপেক্ষা আমরা যা আশা করি; সেগুলোর ওপর আমাদের সচেতন মনকে প্রতিষ্ঠিত করা।’ আবার হার্ভি ম্যাকে বলেছিলেন, ‘একজন গড়পড়তার মানুষ কথা বলে। একজন ভালো মানুষ ব্যাখ্যা করে। একজন ঊর্ধ্বতন মানুষ কাজ করে দেখায়। একজন সেরা মানুষ অন্যদের প্রেরণা জোগায়, যাতে তারা নিজেরাই কাজকে নিজের মতো করে দেখাতে পারে।’ প্রতিটি মানুষের জীবনে নিজস্ব দর্শন, আদর্শ ও লক্ষ্য থাকা উচিত। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, জীবনে সফলতাই একমাত্র বিষয় নয়। ছোট ছোট অর্জন, প্রাপ্তি, সামান্য সুখানুভূতি, মধুর স্মৃতিময় সময়Ñ এসব কিছুর গুরুত্বও জীবনের জন্য অপরিহার্য। তার চেয়েও বড় কথাটি হলোÑ সফলতা মানে সব কিছুতে জিতে যাওয়া নয়। নিজে না হেরে অপরকে জিতিয়ে দেওয়াও সফলতা। অর্থাৎ নিজেরও ক্ষতি হলো না, কিন্তু অপরের লাভ হলোÑ এটাও সফলতা। সফলতা মানে জীবনজুড়ে অসংখ্য ছোট ছোট অর্জনের সমাহার। আবার সুসময়ে বড় বড় অর্জনের চেয়েও দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই বিরাট সফলতা। কারণ দুঃসময়ে মানুষ বেশি ভুল করে, ব্যর্থতার গ্লানি টানে। তবে প্রতিটি মানুষের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত সুস্থ্য-সুন্দর-স্বাভাবিক ও সাধারণভাবে বেঁচে থাকা। অনেক টাকার মালিক হওয়া কখনোই সফলতা নয়।

মনে রাখতে হবে, মানুষ সবার আগে ব্যক্তিগত সমস্যা দ্বারা আক্রান্ত হয়। সমস্যার কারণ যে বা যাই হোক সমস্যা নিয়ে দুর্ভাবনা না করে বরং সমাধানের চেষ্টা করাটাই বড় কথা। প্রতিটি সমস্যার সমাধান আছেই। অনেক সময় সমস্যার কারণটি খুঁজে বের করতে পারলে সমাধানের পথটিও খুলে যায়। একভাবে সমাধান না হলে চেষ্টা করতে হবে অন্যভাবে। সমস্যার আদল অনুযায়ী বরং নিজের চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সমস্যাগ্রস্ততা মনের ভেতর অসহায়ত্ব আর সীমাবদ্ধতাকে বড় করে তোলে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close