মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯

মুক্তমত

অবক্ষয় রোধে চাই সচেতনতা

আজ বিশ্বব্যাপী পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বত্র অবক্ষয়ের ছাপ। নৈতিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ভীতসন্ত্রস্ত, অশান্তি ও অস্থিরতা বাড়ছে পৃথিবীজুড়ে। ফলে পারিবারিক কলহ, অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা, যৌন বিকৃতি, কুরুচিপূর্ণ সমকামী ও বহুকামিতার মতো পশুসুলভ যৌনাচরণ সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে। সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ার প্রায় ৫০ শতাংশ খবরই সমাজিক অবক্ষয়ের। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ছেলের হাতে মা খুন, দুলাভাইয়ের হাতে শ্যালিকা খুন, পুত্রের হাতে পিতা খুন। আবার ধর্ষণ, গুমের খবরও কম নয়। বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের খবর দেশের সর্বত্রই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে চলেছে। যেখানে নৈতিকতা অনুপস্থিত, সেখানে সামাজিক অবক্ষয় সবচেয়ে বেশি। সুশীলজন মনে করছেন, দেশের সর্বাঙ্গে আজ নৈতিকতার অনুপস্থিতির কারণে এ অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নিপীড়নের স্বীকার, পদপদবির লোভে মানুষ নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাছাড়া দেশের সর্বত্র মাদকের জয়জয়কার ধ্বনি। মাদকদ্রব্য যুবসমাজকে গ্রাস করছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিরাই সামাজিক অবক্ষয় সৃষ্টি করছে। বিয়েবন্ধনে কঠিনতম পদ্ধতি অবলম্বনের ফলে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, বিয়ে-পূর্ব সম্পর্ক, বিয়ের পর পরকীয়া, যথাসময়ে বিয়ে সম্পন্ন না হওয়া, একক সিদ্ধান্তে বিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়াও সম্পদের লোভ, ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি, সহশিক্ষা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, নারীদের বৈচিত্র্যময় উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ পোশাক ও সমাজে হালাল-হারামের অনুপস্থিতি সামাজিক অবক্ষয়ের মূল কারণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অবক্ষয় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে যুবসমাজ আরো বেশি এতে পা বাড়াচ্ছে। পর্নোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি ছাড়াও বর্তমান সময়ে কুরুচিপূর্ণ ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে ফেসবুকে; যা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। যুবসমাজের হাতের মুঠোয় আজ বিশ্ব। ডিজিটাল এ যুগে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট প্রতিটি যুবকেরই রয়েছে। ফেসবুকে নগ্ন ভিডিও দেখে তরুণ প্রজন্ম অবক্ষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে দিন দিন।

এসব ফুটেজে অংশ নেওয়া ছেলেমেয়েরাও যেমন এ সমাজের অংশ, তেমনি যারা এর ক্রেতা, তারাও এ সমাজেরই অংশ। এর সিংহভাগই আবার তরুণ প্রজন্ম। যারা স্বাধীনতার নামে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে বেহায়াপনার শেষসীমা অতিক্রম করে চলেছে রোজ। আমরা জেনেও এর প্রতিকারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাদের সহযোগিতাই করে চলেছি দায়িত্বজ্ঞানহীন অপদার্থের মতো। যে ছেলেটি তার মোবাইলে এই ভিডিও ফুটেজগুলো দেখে রাস্তায় বেরোয়, তার কাছে সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েটি আর ফুটেজে দেখা মেয়েটিকে একই মনে হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। আর তখন যে সে ওই মেয়েটিকে হেনস্তা করতে চাইবে, ইভটিজিং করবেÑ এটাও কি স্বাভাবিক নয়? আমাদের নাটক-সিনেমার গানে তুমি-আমি ছাড়া কিছুই নেই। মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেটাকে উসকে দিচ্ছে আরো। ভাবখানা এমন, যেন বন্ধু পাশে থাকলেই হলো, আর কারোর প্রয়োজন নেই। বন্ধুত্ব মানেই প্রেম। প্রেমের জন্যই জীবন। আর প্রেম মানেই বেহায়াপনা। জীবনের আর কোনো লক্ষ্যই নেই! ঠিক একইভাবে ইন্টারনেট মানেই ফেসবুক। ফেসবুক মানেই ফেক আইডি আর মিথ্যের ছড়াছড়ি! বন্ধুত্ব-প্রলোভন, প্রেম, অতঃপর বাস্তবতার কাঁধে রক্তাক্ত অন্তর। এরপর নেশা। তবে ফেসবুকেও আছে জ্ঞানগর্ভ অনেক ভালো ভালো পাতা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, তার পাঠক সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। এভাবে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে যুবসমাজ অবক্ষয়ের পথে এগিয়ে চলেছে। আবার নারীদের পোশাক ও চলাফেরার ক্ষেত্রেও অবক্ষয়ের কারণ রয়েছে। দেশের প্রতিটি পার্ক ও দর্শনীয় স্থানগুলোতে প্রেমবিনিময়, প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি বেঁধে প্রকাশ্য অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। আবার আলো-আঁধারি কিছু হোটেল, মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, সাইবার ক্যাফেগুলোতেও অসামাজিক কার্যকলাপ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টাই অসামাজিক কার্যকলাপ চললেও আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। খ্যাতিমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ইভটিজিং, নারীদের উত্ত্যক্তকরণ, খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সময়ে যেকোনো পার্কের পরিবেশ এমনই যে, সাধারণ মানুষ ইতস্তবোধ করতে বাধ্য। সংস্কৃতির আগ্রাসন ও অপসংস্কৃতির কারণেও সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেল জি সিনেমা, স্টার প্লাস, স্টার জলসার বাহারি অনুষ্ঠানে যা সম্প্রচার করা হয়, তা থেকে সমাজের শেখার কিছুই নেই। বরং ভাবির সঙ্গে দেবরের সম্পর্ক, পরকীয়া, ননদ-ভাবির ঝগড়া, বউ-শাশুড়ির অমিল, সম্পদের ভাগবাটোয়ারা, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে খারাপ আচরণ ইত্যাদিই বেশি শিখছে। ফলে তা সমাজের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।

নৈতিক শিক্ষার অভাব, আবার সহশিক্ষা ও আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে যৌন উন্মাদনার শিক্ষা প্রদানও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ। ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণিপড়–য়া একজন শিক্ষার্থীর স্বাভাবিকভাবে যৌনতা কিংবা তার অনুভূতি জানার কথা নয়। কিন্তু গার্হস্থ্য, অর্থনীতি ও সমাজ পাঠ্যবইয়ে যৌনতার অনুভূতি সৃষ্টির কতক শব্দ ও ধারণা দিয়ে এসব কোমলমতি শিশুকে যৌনতার দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি সামাজিক অবক্ষয়ের কিছু চিত্র ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। রাজধানীর আদাবরে মায়ের অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় মা আয়েশা হুমায়রা নিজের হাতে খুন করে সাড়ে পাঁচ বছরের শিশুসন্তান খন্দকার সামিউলকে। একই কারণে মধ্যরাতে বাড্ডায় মা আরজিনা হত্যা করে ৯ বছরের শিশু নুসরতকে। নুসরত হত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কাকরাইলে আলমগীর কবিরের নির্দেশে হত্যা করা হয় তার স্ত্রী শামসুন্নাহারকে। আর মা হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ছেলে শাওনকে। হত্যার পেছনে ছিল অবৈধ সম্পর্ক ও পারিবারিক কলহ। এ ছাড়াও রাজধানীর বনশ্রীতে মাহফুজা নামের এক মা তার ১২ বছর বয়সি অরনী ও ৭ বছর বয়সি আলভীকে হত্যা করে। পরকীয়া দেখে ফেলায় নরসিংদীতে চাচি তমুজা বেগম হাত-পা বেঁধে সারা শরীরে কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে ১৩ বছরের কিশোরী আজিজাকে। ফরিদপুরে মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে কিশোর মুগ্ধ। চুয়াডাঙ্গায় স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ায় মাছ ব্যবসায়ী রিপনকে হত্যা করে তার বন্ধু মাঈনুদ্দিন। গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলায় বাবা জুয়েল তার পরকীয়া প্রেমিকাকে বিয়ে না করায় গুম করে হত্যা করা হয় জুয়েলের পুত্রশিশু আমিনকে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদের জেরে গুরুতর আহত হন পাঁচজন। চট্টগ্রামে চলন্ত বাসে পোশাককর্মী নির্মমভাবে হয় ধর্ষিত। গাজীপুরে পোশাককর্মীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করার মতো জঘন্য ঘটনাও ঘটে। স্বামী-স্ত্রী, মা-বাবা, কিশোর-কিশোরী, পিতা-পুত্র, বন্ধুবান্ধবী, প্রেমিক-প্রেমিকা ইত্যাদির মধ্যে সামান্য বিভেদ, বিচ্ছেদ, ঝগড়া, কলহের জের ধরেই এসব হত্যাকা- ঘটে চলেছে সারা দেশে। বিশেষ করে মাতা-পিতার হাতে সন্তান খুনের প্রবণতা ইদানীং ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এ অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মহীনতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরো কিছু বিষয়। ধর্মহীনতার সংস্কৃতি, ধর্মের অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা নির্দেশ করে না; বরং ধর্মই পারে ধর্মান্ধতার অভিশাপ মুক্ত করতে। ধর্মই মানুষের জীবনপ্রণালি অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা করেছে। মানুষকে সভ্য করেছে। আজ ধর্মকে ত্যাগ করে আমরা পুনরায় অসভ্য-বর্বরতার যুগেই ফিরে যাচ্ছি। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আমরা ধর্মকে মনে করি এগিয়ে চলার পথের প্রধান অন্তরায়। ইতিহাস সাক্ষী, প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতার খোঁজও মেলে না, যেটি ধর্মহীনতাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বালাই নেই সমাজের কোথাও। এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটিও দখল করে নিয়েছে ঈর্ষা আর স্বার্থের দ্বন্দ্ব। যা আনন্দঘন একটি পরিবেশকেও করে তুলেছে রণক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রেও সন্তানরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে সন্তান অস্বাভাবিক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবেÑ এটাই স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে শিক্ষকের ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সুশাসনের অভাব, পারস্পরিক দূরত্ব বৃদ্ধি, দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সমাজে পেশিশক্তির প্রভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃৃতি; সর্বোপরি লাগামহীন অশ্লীলতাই আজকের তরুণ সমাজকে চরম অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুশীলন, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করাসহ সর্বক্ষেত্রে অশ্লীলতাকে শুধু বর্জনই নয়; প্রতিরোধ করা আজ আমাদের সবার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। যার শুরুটা হতে হবে গৃহাভ্যন্তর থেকেই। সবারই মনে রাখা উচিত, সামাজিক সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতার হয়তো প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু মূল দায়িত্বটি পরিবার তথা সমাজকেই নিতে হয়। সন্তানকে সময় দিন। তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার বন্ধুদের জানুন। তাকে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিন। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে সন্তানদের আদর্শবান নাগরিক ও সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে মরণব্যাধি অবক্ষয় থেকে দেশ, জাতি, সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব।

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

আল জামিআতুল ইসলামিয়া, ইসলামপুর, গোপালগঞ্জ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close