মোতাহার হোসেন

  ১৫ অক্টোবর, ২০১৯

পরিবেশ

জলবায়ু ঝুঁকি হ্র্রাসে এক কিশোরীর আর্তি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সিরা একটু চঞ্চল, বেখেয়ালি, অনেকটা হুজুগেই চলেন। তার অমর সৃষ্টি ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক গ্রামের এক সহজ-সরল বালক ফটিককে ‘চঞ্চল, হেঁয়ালি’ প্রকৃতির একজন বালক হিসেবে গল্পে বিধৃত হয়েছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর এই প্রান্তে ডিজিটাল ও বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে সুদূর ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের ১৬ বছর বয়সি বালিকা গ্রেটা থানবার্গ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি গল্পের নায়ক ফটিকের চঞ্চলতাকে ছাড়িয়ে এখন বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে ওই কিশোরীকে হিরোইন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরির্তনজনিত ঝুঁকি থেকে বিশ্ববাসীকে পরিত্রাণে বিশ্বের অনেক দেশের সব কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীর রাজপথে দাঁড় করিয়েছেন তিনি।

গ্রেটা থানবার্গ, বয়স মাত্র ১৬ বছর। অথচ এই বয়সেই তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বের অন্যতম দাপুটে কণ্ঠস্বর। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল থাবা থেকে এই ধরিত্রীর মানুষকে রক্ষায় ছোট্ট এই মেয়েটির ডাকে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নেমেছে লাখ লাখ মানুষ, রব উঠেছে ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাও, পৃথিবী বাঁচাও’। গত ২০ সেপ্টেম্বর শনিবার জতিসংঘের সদর দফতর নিউইয়র্কসহ সারা বিশ্বে মানববন্ধন হয়েছে তার আহ্বানে। তার দাবি, একটাই পৃথিবী নামক আমাদের গৃহে আগুন লেগেছে, এই আগুনে আমরা সবাই মরে যাবÑ তাই সময় থাকতে এখনই এই পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে। আগুন নেভাতে হবে। এ জন্য জিরো কার্বন ব্যবহার করতে হবে। ২০১৮ সালের আগস্টে নিজ দেশের সংসদ ভবনের সামনে পরিবেশ রক্ষার দাবিতে একা আন্দোলনে নামে এ সুইডিশ কিশোরী। আন্দোলনের নাম দেওয়া হয় ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট’। এর পরপরই সাড়া পড়ে যায় সারা বিশ্বে। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্কুল-কলেজের হাজারও শিক্ষার্থী।

গত এপ্রিলেই বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের তালিকায় প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে এই কিশোরী। এ বছর নাম এসেছিল শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ীদের সম্ভাব্য তালিকায়ও। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাকে বলা হচ্ছে ‘নেক্সট জেনারেশন লিডার’। এই কিশোরী যে কতটা প্রভাবশালী তার প্রমাণ মিলেছে গত ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার। জাতিসংঘ জলবায়ু সামিটে অংশ নিতে আমন্ত্রণ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যায় গ্রেটা থানবার্গ। তবে অধিবেশন শুরুর আগেই রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে এ কিশোরী। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের আন্দোলন। ২০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার প্ল্যাকার্ড-সেøাগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল জাতিসংঘ সদর দফতর-সংলগ্ন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান। জড়ো হয়েছিলেন লাখ লাখ মানুষ। তাদের সবারই এক দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাও। এদিন নিউইয়র্কের ব্যাটারি পার্কের সমাবেশে পৌঁছামাত্রই রীতিমতো রকস্টারের মতো সংবর্ধনা পান গ্রেটা থানবার্গ। চারদিকে শুরু হয় গ্রেটা, গ্রেটা গ্রেটা রব।

সেদিন জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে উপস্থিত হাজারও শিশু-কিশোর সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কী বলবে তাদের কিশোরী নেতা। কিন্তু হতাশ করেনি গ্রেটা। বরাবরেই মতোই সাহসী বক্তব্য দিয়ে মাতিয়ে তোলে আন্দোলনকারীদের। গ্রেটা থানবার্গ বলে, এটিই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়বায়ু আন্দোলন। এ নিয়ে আমাদের গর্ব করা উচিত। কারণ আমরা সবাই মিলেই এটি করছি। তার মতে, আন্দোলনে অন্তত ৪০ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে এবং এ সংখ্যা আরো বাড়ছে। মূলত গ্রেটা এখন আর শুধু সুইডেনের নয়, হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্বের নাগরিক। বাবা-মায়ের ছোট্ট বাড়ি নয়, এখন পৃথিবীটাই গ্রেটার ঘর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই ঘর আজ ধ্বংসের মুখে। গ্রেটার বক্তব্য, আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে। আর এটা শুধু ছোটদের ঘর নয়, আমরা সবাই এ ঘরেই থাকি, এটা সবারই ক্ষতি করছে। বয়স কম হলেও বিশ্বরাজনীতি ভালোই বোঝে গ্রেটা। ক্ষমতাবান নেতারা বহুবার জলবায়ু পরিবর্তন রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ নিয়ে তার কথা, নেতাদের শূন্য প্রতিশ্রুতিগুলো সবই এক, মিথ্যাগুলো এক, একই তাদের নিষ্ক্রিয়তা। এ কারণে সবার দৃষ্টি ছিল জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের দিকে। গ্রেটা বলেন, তাদের সুযোগ এসেছে নেতৃত্ব নিয়ে প্রমাণ করার যে, তারা আসলেই আমাদের কথা শুনতে পান। শুধু চমৎকার বক্তৃতাই নয়, বিশ্বনেতাদের কাছে রীতিমতো সতর্কবার্তাও দিয়ে রেখেছে গ্রেটা থানবার্গ। বক্তব্য শেষ করার আগে গ্রেটা প্রশ্ন রাখে, কে আমাদের ভয় পাচ্ছে? জনগণের শক্তি এমনই। মাত্র তো শুরু। তাদের ভালো লাগুক না লাগুক, পরিবর্তন আসবেই। শুধু কথায় কখনো নেতা হওয়া যায় না, কাজেও প্রমাণ দেখাতে হয়। গ্র্রেটা সেটা ভালোভাবেই বুঝেছে।

সুইডেন থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেতে তিনি প্লেন বা জাহাজে উঠেননি, গিয়েছেন নৌকায় চড়ে। কারণ ইঞ্জিনচালিত যানবাহনও পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ, আর তার আন্দোলন পরিবেশ রক্ষার জন্যই। এর পেছনের ইতিহাস হচ্ছে, কিরিবাতি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভানুয়াতুর মতো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা যোগ দিয়েছেন গ্র্রেটার জলবায়ু আন্দোলনে। তাকে সমর্থন জানিয়েছে অনলাইনে পোস্ট করেছেন আন্দোলনের ছবি। অস্ট্রেলিয়ায় অন্তত সাড়ে তিন লাখ মানুষ যোগ দিয়েছেন এ আন্দোলনে। কিছু কিছু এলাকায় স্কুলশিক্ষার্থী ও শ্রমিকদেরও আন্দোলনে নামতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আন্দোলন ছড়িয়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকায়ও। ঘানায় শিক্ষার্থীরা রাজধানী আকরা অভিমুখে পদযাত্রা করেছে। ভারত-থাইল্যান্ডে ‘ডাই-ইন’ (মৃতের অভিনয়) করেছেন আন্দোলনকারীরা। জার্মানির পাঁচ শতাধিক শহরে পথে নেমেছেন জলবায়ু আন্দোলনকারীরা। দেশটির সরকার ইতোমধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে ৫৪ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। আর যুক্তরাজ্যের চারটি দেশেই লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ক্রমান্বয়ে এই আন্দোলন আরো জোরদার হবে।

সড়কে সড়কে বছরখানেক প্রতিবাদের পর নিউইয়র্কে ছিল গ্রেটা থানবার্গের বিশ্বমঞ্চে কথা বলার সুযোগ। তার অসন্তুষ্টি ছিল না। চোখে-মুখে আবেগ নিয়ে দেওয়া বক্তৃতায় বিশ্বনেতাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছে সে এবং বারবার প্রশ্ন রেখেছে, এত বড় স্পর্ধা আপনারা কোথায় পান? পরে টুইটারসহ সামাজিক মাধ্যমে তার এই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। আর এতে বিশ্বের বড় বড় কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোর ব্যাপক প্রতিশ্রুতির ফাঁকফোকরও বেরিয়ে এসেছে। সমাবেশগুলোতে নিজে বেশি সময় না নিয়ে অল্প-পরিচিত কর্মীদের বক্তব্য দিতে মাইক তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, যাতে জলবায়ু ইস্যুতে আরো অনেক কণ্ঠ জেগে ওঠে। তবে গ্রেটা জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেসের ডাকা ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে পাওয়া সবটুকু সময় কাজে লাগাতে চেয়েছে। প্যারিস চুক্তিকে জোরদার করতেই এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।

শ্রোতাদের উদ্দেশে এ কথা বলে সে বক্তব্য শুরু করেÑ ‘আমার বার্তা হচ্ছে, আমরা আপনাদের পর্যবেক্ষণ করছি।’ এতে কারো কারো মুখে হাসি এলেও মুহূর্তেই তা মিইয়ে যায়। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সে যেদিকে যাচ্ছে, সেটি কোনো তামাশা নয়। ক্ষোভ প্রকাশ করে সে জানায়, সবকিছুই ভুল। আমার তো এখানে থাকার কথা ছিল না। সমুদ্রের ওই প্রান্তে স্কুলে থাকার কথা ছিল। ১৬ বছর বয়সি এই কিশোরী জানায়, কিন্তু আপনারা আমাদের ছোটদের কাছে আশার কথা শুনতে এসেছেন। গ্রেটা জানায়, ফাঁকা বুলি আউড়িয়ে আপনারা আমার স্বপ্ন ও শৈশবকে চুরি করেছেন। কিন্তু ভাগ্যবতীদের মধ্যে আমি একজন। লোকজন ভুগান্তিতে রয়েছেন, তারা মারা যাচ্ছেন, পুরো প্রাণ প্রকৃতি ভেঙে পড়ছে। একটি ব্যাপক বিলুপ্তি শুরুর মধ্যে আমরা রয়েছি। একটি স্থায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির রূপকথার গল্প ও অর্থ, যা নিয়ে আপনারা কথা বলতে পারেন। এত স্পর্ধা আপনারা কই পান! ‘আমি কতটা কাতর ও ক্ষুব্ধ, তাতে কিছু যায় আসে না- আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না। যদি আপনি পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারেন, কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন, তখন আপনি অশুভ হয়ে যাবেন এবং আমি তা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করব।’

বক্তব্যকে আরো জোরদার করতে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে একের পর এক বিপজ্জনক ঘটনার তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে গেছে এই কিশোরী। গ্রেটা বলে, আপনারা আমাদের ব্যর্থ করে দিচ্ছেন, কিন্তু ছোটরা আপনাদের প্রতারণা বুঝতে শুরু করেছে। এই সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলন কর্মী জানায়, সব ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনাদের ওপর নজর রাখছে। যদি আপনারা আমাদের ব্যর্থ করে দিতে চান, তবে আমরা আপনাদের কখনো ক্ষমা করব না। গ্রেটার পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিশ্বের সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত দেশের শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ এবং দেশের আপামর জনগণের পূর্ণ সর্মথন থাকবে। আশা করছি, গ্রেটার আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে জলবায়ু ঝুঁকি থেকে বিশ্ব বাঁচবে, আমরা বাঁচব।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জজার্নালিস্ট ফোরাম (বিসিজেএফ)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close