মো. আবু তালহা তারীফ

  ০৬ মে, ২০১৯

রমজান

তারাবি ও সাহ্রি দিয়ে শুরু

রমজান মাসের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই রহমত ও বরকতপূর্ণ মাস রমজান শুরু হবে। আমরা সবাই টুপি, পাঞ্জাবি পরিধান করে হাতে সুন্দর জায়নামাজ নিয়ে পবিত্র তারাবি নামাজ আদায় করতে মসজিদে যাই। আমরা অন্য মাসে অন্যান্য রোজা রাখি, কিন্তু তারাবি নামাজ পড়ি না। রমজানে প্রতি রাতে আমরা তারাবি নামাজ আদায় করি। তারাবি নামাজের মাধ্যমে পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়। তারাবি নামাজ ফরজ, সুন্নত, নফল নামাজের মতো আদায় করতে হয়। তারাবি নামাজ পড়াকালে প্রতি দুই রাকাত বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করে দোয়া ও তসবিহ পাঠ করতে হয় বলে এ নামাজকে সালাতুত তারাবিহ বা তারাবি নামাজ বলা হয়। অধৈর্য হয়ে তারাবি নামাজ আদায় করা যাবে না। মসজিদে প্রবেশ করলে দেখা যায়, কেউ তারাবি নামাজের নিয়ত করেছেন। রুকু দিচ্ছেন, সেজদা করছেন এবং গণনা করছেন কত রাকাত হয়েছে। বিশ রাকাত নামাজ পড়তে কত সময় লাগবে। অন্তরে বিরাজ করে নানা রকমের ধারণা। নামাজে নেই কোনো ধৈর্য। নামাজ ধৈর্যসহকারে না আদায় করা কঠিন কাজ শুধু ইমানদার ব্যক্তি ব্যতীত। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই এ নামজ অত্যন্ত কঠিন কাজ, তবে অনুগত বান্দাদের জন্য তা কঠিন নয়’। (সুরা আল বাকারা-৪৫)।

তারাবি নামাজ আদায় করতে হবে যতœসহকারে। যতœসহকারে তারাবি নামাজ আদায় করার জন্য প্রিয় নবী (স.) নির্দেশ দিয়েছেন। রসুল (স.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর দিনের বেলায় রমজানের রোজাকে ফরজ করেছেন, আর আমি তোমাদের জন্য তারাবি সুন্নত পে ঘোষণা দিলাম। যে ব্যক্তি নেকির জন্য রমজান মাসের দিনে রোজা রাখবে এবং রাতে তারাবি নামাজ আদায় করবে, সে তার পাপ থেকে এমনভাবে মুক্ত হবে যেমন সন্তান মাতৃগর্ভ তেকে ভূমিষ্ঠ হয়’। (নাসাঈ শরিফ)।

রাতে তারাবি নামাজ আদায় করে সারা রাত অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি কখন সাহ্রি খাওয়ার সময় হবে। পরদিন মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য রোজা রাখব। সাহ্রি খাওয়ার সময় অনেকে কখন ঘুম থেকে উঠব, সেসময় মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখে, অনেকে আবার অন্যকে বলে সাহ্রির খাওয়ার সময় উঠিয়ে দিও। সাহ্রি খাওয়ার সময় ঘুমিয়ে থাকলে একে অন্যকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেন। বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, মসজিদের মাইকে বিভিন্ন সময়ে মুয়াজ্জিন সাহেব বলেন, উঠুন স্হারি খাওয়ার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে আর ৩০ মিনিট কিংবা ৪০ মিনিট বাকি আছে। মসজিদের মাইকে সাহ্রি খাওয়ার জন্য সময় বলে দেওয়া হচ্ছে। আগামীকাল রোজা রাখার নিয়তে শেষ রাতে বরকত লাভের জন্য কিছু খাওয়াকে সাহ্রি বলা হয়। ইমাম তাবারানী (রহ.) বর্ণনা করেছেন রসুল (স.) বলেন, ‘সাহ্রি ভক্ষণকারীর খাবারের হিসাব হবে না’। তাছাড়া সাহ্রি খাওয়া রসুল (স.) এর একটি সুন্নত। রসুল (স.)-এর হাদিস শরিফে সাহ্রি খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রসুল (স.) বলেন, ‘তোমরা সাহ্রি খাও, কেননা তাতে বরকত রয়েছে’। (বোখারি : ১৯২৩)।

রসুল (স.) সাধারণত দেরি করে সাহ্রি খাবার খেতেন, তাই রাতের শেষ প্রহরে সাহ্রি খাওয়া সুন্নাত। রসুল (স.) বলেন, ‘আমার উম্মত কল্যাণের সঙ্গে থাকবে যত দিন তারা তাড়াতাড়ি ইফতারি করবে এবং সাহ্রি দেরি করে করবে’। তবে এত বেশি দেরি করা ঠিক নয়, যাতে সুবহে সাদিক হয়ে যায় বরং সুবহে সাদেকের কিছুক্ষণ আগে সাহ্রি খাওয়া শেষ করা উচিত। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত যায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বলেন, আমরা রসুল (স.) সঙ্গে সাহ্রি খেতাম। সাহইর খাওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি ফজরের নামাজে দাঁড়াতেন। আমি (আনাস) বললাম, আজান ও সাহ্রির মাঝে কত সময় থাকতেন, তিনি বললেন ৫০টি আয়াত পড়ার সমপরিমাণ। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে, সাহ্রির শেষ সময় নির্ণীত হবে সুবহে সাদিক অথবা ফজরের আজান দ্বারা নয়। সুতরাং যদি কেউ সুবহে সাদিকের আগে আজান দেয়, তবে সে আজানের পরও সাহ্রি খাওয়া জায়েজ হবে। পক্ষান্তরে আজান যদি সুবহে সাদেকের পরে দেয়, তবে আজান চলাকালীন তো দূরের কথা আজানের শুরুতে বা তার পূর্বক্ষণেও খাওয়া জায়েজ হবে না। আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, আমাদের দেশে ফজরের আজান সুবহে সাদিকের পরই দেওয়া হয়ে থাকে। তাই আজান চলাকালীন কিছু খেলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। অনেকেই দেখা যায়, ইচ্ছাকৃতভাবে সাহ্রি না খেয়ে রোজা রাখেন, ইচ্ছাকৃতভাবে না খেয়ে রোজা রাখা ঠিক না। যে ব্যক্তি সাহ্রি খায় তার ওপর রহমত নাজিল করা হয়। রসুল (স.) বলেন, ‘সাহ্রি ভক্ষণকারীদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার রহমত নাজিল করেন এবং ফেরেশতারা তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করেন।’ (ইবনে হিব্বান-২৪৬)।

সাহ্রি খাওয়ার কারণে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়, তাই হজরত ওমর (রা.) বলেন, রসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমরা এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সাহ্রি খাও’। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রসুল (স.) বলেছেন তোমরা সাহ্রি খেয়ে দিনের রোজার ওপর শক্তি অর্জন কর’। (ইবনে মাজাহ)।

আমরা জানি, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ বা রুকনের মধ্যে রোজা একটি অন্যতম স্তম্ভ। আলাহর সন্তুষ্টি ও খোদাভীতির জন্য রোজা একটি অতুলনীয় ইবাদত। রোজা মানুষকে যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। রসুল (স.) বলেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ’। (বুখারি)।

রোজার মাধ্যমে বান্দাকে যাবতীয় অপকর্ম এবং পানাহার হতে দূরে রাখে। মানুষ ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর হয়েও মহান প্রভুর ভালোবাসা এবং ভয়ে কিছুই গ্রহণ করে না। সেহেতু রোজা বান্দার অন্তরে আলাহর প্রেমের গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করে। তাছাড়া রোজা পালনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করা হয়। রোজা মানুষের মাঝে তাকওয়া বা খোদাভীতি সৃষ্টি করে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা :১৮৩)।

রোজা পালনকারী ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের জন্য রোজা পালন করে থাকেন। কেননা, রোজা অবস্থায় লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে যে যাবতীয় পানাহার করতে পারে, কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার ভয়ে এবং তার আদেশ পালন করার জন্য যাবতীয় পানাহার, অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। তাছাড়া রোজা মানুষকে সাফায়াত করে। রসুল (স.) বলেন, রোজাসমূহ এবং আল-কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ আমি এ ব্যক্তিকে দিনে খাবার ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কোরআন বলবে, আমি এ ব্যক্তিকে রাতের নিদ্রা হতে ফিরিয়ে রেখেছি। আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ (বায়হাকি শরিফ)।

রোজা এমন একটি ইবাদত যা পালন করলে বান্দার পরবর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেওয় হয়। রসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের ও আত্মবিশেষণের সঙ্গে সাওম পালন করল, সে পূর্ববর্তী গুনাহ মার্জনা করে দিল’। (বুখারি)

পবিত্র রমজান মাসকে ১০ দিন করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। প্রথম ১০ দিন রহমত এরপর ১০ দিন মাগফিরাত ও শেষের ১০ দিন নাজাত। রসুল (স.) বলেন, পবিত্র রমজানের প্রথমাংশকে রহমত, দ্বিতীয়াংশকে মাগফিরাত এবং তৃতীয়াংশকে দোজখ হতে মুক্তি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। (বায়হাকি শরিফ)।

রমজানুল মোবারক মাস হলো তাকওয়ার মাস। রমজান মাসে রোজা পালনের মাধ্যমে বান্দা অধিকতর তাকওয়া ও পরেহজগারি হাসিল করতে সক্ষম হয়। তাকওয়া অর্জন করার জন্য রোজা পালন বাধ্যতামূলক। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করে হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বনকারী হতে পার’। (সুরা বাকারা-১৮৩)।

মুমিনদের জন্য বোনাসস্বরূপ অর্থাৎ সওয়াব বৃদ্ধির মাস হলো রমজান মাস। এ মাসে একটি নফল ইবাদতের মূল্য অন্য মাসের একটি ফরজ ইবাদতের সমান। একটি ফরজ ইবাদত পালন করলে সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমান। রসুল (স.) বলেন, ‘রমজান মাসের একটি ফরজ ইবাদতের ফজিলত অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমতুল্য। আর এ মাসের একটি নফল ইবাদতের মূল্য অন্য মাসের একটি ফরজ ইবাদতের সমান’। (বায়হাকি শরিফ)।

শয়তানকে বেঁধে রাখার মাস হলো মাহে রমজান। রমজান মাসের রোজা আদায়ের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জগতে উচ্চ মকামে আরোহণ করা যায়। আল্লাহর বান্দারা যেন আল্লাহর মহব্বত ও ভালোবাসা অর্জন করতে পারে, এজন্য রমজান মাসে শয়তানকে গতি রোধ করা হয়। এজন্য শয়তানকে এ মাসে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। রসুল (স.) বলেন, ‘পবিত্র রমজানে শয়তানকে শিকলবদ্ধ করা হয়’। ( মিশকাত)।

রমজান মাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত্রি রয়েছে, যা অন্য কোনো মাসে নেই। সেই রাত্রটির নাম লাইলাতুল কদর। আল্লাহর পক্ষ হতে মুসলিম উম্মাহের জন্য লাইলাতুল কদর এক বিশেষ দান। পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের কোনো এক রাতে এই লাইলাতুল কদর হয়ে থাকে। এই রাতে ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কদরের রাত হাজার মাস হতে উত্তম’। (সুরা আল কদর-৩)।

জান্নাতের দরজা খোলা ও জাহান্নামের দরজা বন্ধের মাস হলো মর্যাদা সম্পূর্ণ মাহে রমজান। রমজান মাসের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জান্নাতের দরজা খোলা ও জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। রসুল (স.) বলেছেন, ‘রমজান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়’। (তিরমিজি শরিফ)।

সর্বোপরি আমাদের সবার মাহে রমজানের সব রোজা রাখতে হবে। কেননা বেহেশতের মধ্যে আটটি দরজা রয়েছে। এর একটি হলো রায়হান। রসুল (স.) বলেন, ‘রায়হান নামের দরজা দিয়ে রোজাদার ব্যতীত অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না’। (বুখারি, মুসলিম শরিফ)।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close