সোলায়মান মোহাম্মদ

  ০৩ মে, ২০১৯

মতামত

মানবতার মহাক্রান্তিকাল

বিশ^বাসী নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে বর্বরতম হামলায় নিহত মানুষের শোকের রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শ্রীলঙ্কায় আবারও সন্ত্রাসী হামলা। প্রায় ৪০০ মানুষ সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ল। ৫০০-৬০০ মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর অন্যদিকে সন্ত্রাসীরা বুনো উল্লাসে মেতে উঠেছে। বুনো উল্লাস শেষে হয়তো তারা আবারও পৃথিবীর অন্য কোথাও শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের দেশেও নাকি এমন সন্ত্রাসী বোমা হামলার চেষ্টা চলছে, যা প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট দক্ষ ও সচেতন বলে সুযোগ পাচ্ছে না। সন্ত্রাসী হামলা না হলেও আমাদের দেশে মানবতা বলতে আজ আর কিছু নেই। স্বার্থবাদিতা, অর্থালোভ ও ক্ষমতার মোহে মানবতা আজ নিরুদ্দেশ। কোথায় হারালো মানবতা বলতে পারেন? কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু, সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর-রুনি আজও মানবতা খোঁজে বেড়াচ্ছে। সর্বশেষ নুসরাত সেই মানবতার খোঁজে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। তনুর মা আনোয়ারা বেগম এখন আর প্রশাসনের কাছে বিচার চান না, আকাশের পানে আল্লাহর কাছে মেয়ে হত্যার বিচার প্রার্থনা করেন। নুসরাতের বিচার শেষবেলায় এসে কোথায় পৌঁছে বলা মুশকিল। মিডিয়ার কল্যাণে শুনেছি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তাও নাকি সোনাগাজীর অভিযুক্ত সেই ওসি মোয়াজ্জাম খানের পক্ষে সুপারেশ করেছেন।

হায়রে মানবতা! কোথায় হারালি? শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শেখ সেলিমের শিশু নাতি জায়ান চৌধুরীও নিহত হয়েছে। দেশের প্রায় সব মিডিয়ায়ই বিষয়টি ওঠে এসেছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে প্রকাশিত জায়ানের মৃত্যু সংবাদে অগণিত লোক হা হা হা রিয়েক্ট দেখিয়েছে। বিষয়টি একদিক থেকে খুবই তুচ্ছ, এগুলো ভাবার হয়তো কারো সময় নেই। কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে খুবই লজ্জার। একজন শিশুর নির্মম মৃত্যু সংবাদেও যারা অসভ্যের মতো হাসিতে ফেটে পড়তে পারে তাদের কাছ থেকে জাতি কী আর আশা করতে পারে। শিশুরা নির্দোষ ও নিষ্পাপ তাদের এমন নির্মম মৃত্যুতেও যারা রাজনীতি টেনে আনেন তাদের ধিক্কার জানানোর ভাষাও জানা নেই। মনে হচ্ছে, সব কিছুই আজ নষ্ট রাজনীতির দখলে চলে যাচ্ছে।

আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব। সব দিক থেকেই সৃষ্টির সেরা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের চলায়-বলায়, আদব-কায়দায়, আচার-আচরণ, পোশাকে-আশাকে এমনকি ধর্মেকর্মেও মনুষ্যত্বকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সৃষ্টির সেরা জীবের যেমন বৈশিষ্ট্য থাকার কথা তা যেন একেবারেই হারিয়ে বসেছি। কোথাও মানুষের মনুষ্যত্বকে খোঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই এক প্রকার সুযোগ সন্ধানী হয়ে উঠেছি। আর কয়েক দিন পরই মুসলমানদের পবিত্র মাস রমজান শুরু হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম বিশে^ যেখানে এ মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগের চেয়ে কমে যায় আর বাংলাদেশে সেখানে প্রতিটি পণ্যের দাম আগের তুলনায় বহু গুণ বেড়ে যায়। বলা যায়, ধর্মের নাম ভাঙিয়েই সব থেকে বেশি ফায়দা হাসিল করছে একদল সুযোগ সন্ধানী ধর্ম ব্যবসায়ীরা। ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে একশ্রেণির বক্তারা খোদ নিজেরাই ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। ইসলামে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, ধর্ম প্রচারকালে কোনোরূপ আর্থিক লাভ গ্রহণ করা যাবে না অথচ আমাদের বক্তা হুজুরদের বছরখানেক আগেই টাকা বুকিং দিতে হয় অন্যথায় সিডিউল পাওয়া যায় না। লাখ লাখ টাকা দিয়ে বক্তা আনতে হয়। ফলে ওয়াজ ব্যবসায় কিছু মৌলভী সাহেবরা এতটাই লাভবান হয়েছেন যে কেউ কেউ হেলিকপ্টারে করেও ওয়াজ করতে যান।

মানবতা বর্তমান সময়ে আরো একটি জায়গায় চরমভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত। সেটি হলো, যেখানেই দেখবেন সেবার নাম দিয়ে কিছু করা হচ্ছে। হাতে গুনে গুটিকয়েক বাদে, প্রমাণ করার আগেই মোটামুটি নিশ্চিতভাবে ধরে নেবেন এখানেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে নতুন করে প্রতারণার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণার যতগুলো ধাপ থাকে, প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ ডাক্তাররা তা অতিক্রম করে থাকেন। লাশের সঙ্গেও তাদের ব্যবসা বন্ধ থাকে না। কথা প্রসঙ্গে যেহেতু সুযোগ পেয়েছি, সেহেতু না বলে পারছি না। আমার বাবা মারা গেছেন ৫ বছর হলো। বাবাকে ঢাকা পিজি হাসপাতালের আইসিউওতে ২২ দিন রেখে চিকিৎসা করেছিলাম। প্রতিদিন ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন মতে, ওষুধ ক্রয় করে দিতে হতো। ৪-৫ হাজার টাকার ওষুধ প্রতিদিন। আমি যে ওষুধ ক্রয় করে দিতাম, সেগুলোর মধ্যে পার্মানেন্ট কালি লাগিয়ে দিতাম। পরদিন আবার সেই কালিযুক্ত ওষুধই আমি মেডিসিন কর্নার থেকে ক্রয় করতাম। অর্থাৎ যে ওষুধ আমি ক্রয় করে দিতাম ঠিক সেই ওষুধগুলো আইসিউও থেকে ফার্মেসিতে পাঠাত। কী দারুণ ব্যবসা! অথচ সৃষ্টিকর্তার পর আমরা সাধারণ মানুষ ডাক্তাদেরই জীবনদাতা ভেবে থাকি। পরিবারের কেউ বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হলে ডাক্তারদের বিশ^াস করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তারা যেভাবে বলে ঠিক সেভাবেই আমাদের সব করতে হয়। আর এ বিশ^াসের সুযোগেই ডাক্তাররা তাদের আখের গোছাতে থাকেন।

আমাদের দেশের মানবতার বর্তমান যে রূপ দাঁড়িয়েছে তা হলো, নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা যত অসহায়ই হোক না কেন, ঠিক তাদের কাছ থেকেই ফায়দা হাসিল করে নানা শ্রেণির লোভী মানুষ নামের অমানুষগুলো। ‘কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ’ প্রবাদের সঙ্গে বর্তমানে শতভাগ মিল খোঁজে পাই। কিছুদিন আগে আমাদের গাজীপুরে হঠাৎ করেই ভয়াবহ শীলাবৃষ্টি হয়েছিল। এতে কৃষকের ফসল ঘরবাড়ি সব এক নিমিষেই তছনছ হয়েছিল। গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের ঘরের টিনের চাল ফুটো হয়ে যায়। টিন পরিবর্তন ছাড়া পরিবার নিয়ে রাত্রিযাপন অসম্ভব ছিল। যে কারণে টিন জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন করতে হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, কালবৈশাখী ওই শীলাবৃষ্টির পরই টিনের দাম বাড়িয়ে দেয় একশ্রেণির টিন ব্যবসায়ীরা। টিনের বানপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে রাখে তারা। গ্রামের অসহায় কৃষক পরিবারকে যেখানে সহানুভূতি দেখিয়ে হলেও দাম কিছু কম রাখার কথা; সেখানে সুযোগের সদ্ব্যবহার শুরু করে লোভাতুর ওই ব্যবসায়ীরা।

ঢাকার চকবাজারের কথায় একবার ভেবে দেখুন না কেন! যে রাতে আগুন ধরল ঠিক তার পরদিন সারাক্ষণ পোড়া মানুষ উদ্ধারকাজ চলছে, স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। সারা শহর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, ঠিক সে সময় আমাদের আশপাশের পিকনিক স্পটগুলোতে নাচগান আনন্দ ফুর্তি দেদার চলেছে। কাজেই বলা যায়, আমরা এখন মানবতার মহাক্রান্তিলগ্নে বাস করছি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close