হাসান জাবির

  ২০ এপ্রিল, ২০১৯

বিশ্লেষণ

কোন পথে বিশ্বব্যবস্থা

সিরিয়া ও ইউক্রেন সংকটের ভেতর দিয়ে বিশ্বব্যবস্থা এক নতুন প্রেক্ষাপটের সম্মুখীন হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তন আসন্ন বলেই মনে করা হচ্ছে। মূলত সিরিয়া ও ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার শক্তিশালী পদক্ষেপ এ ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা জোরদার করেছে। ফলে স্নায়ুযুদ্ধ উত্তর বিশ্বব্যবস্থায় গত তিন দশকের একচেটিয়া মার্কিন আধিপত্য গুরুতর হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি গত ১০০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে লক্ষ করব, গত শতাব্দীতে বিশ্ব ইতিহাসে ঘটেছিল নানা ঘটনা। ওইসব ঘটনার সূত্র ধরে বিশ্বব্যবস্থায় এসেছিল বহুমুখী পরিবর্তন। শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক রূপান্তরের নানা প্রক্রিয়া। যেসব ঘটনার নির্যাস আজও বিদ্যমান আছে। তার মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা। অন্যদিকে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই সংঘটিত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন এনেছিল। এরপরে ইউরোপে নাৎসি জার্মানির পুনঃশক্তি সঞ্চয় এবং ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত বিশ্বব্যবস্থার ধরন পাল্টে দিয়েছিল। অন্যদিকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু অস্ত্র উৎপাদন সাফল্য ছিল ভিন্নমাত্রার ঘটনা। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জাপানে পরমাণু বোমার আক্রমণ। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয় সত্ত্বেও মিত্রপক্ষের ইউরোপীয় শক্তিসমূহের বিপর্যয়ের ফলাফল এখানে প্রণিধানযোগ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় শক্তি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের শক্তির ক্ষয়জনিত বিপর্যয়ের ফলে দেশ দুটি বিশ্বশক্তির কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েছিল। এর ফলে সৃষ্ট শূন্যতার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্তিশালী পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। অন্যদিকে তখন থেকে দুই পরাশক্তির মধ্যকার মতাদর্শিক বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের তীব্র লড়াই; যা স্নায়ুযুদ্ধ নামে অভিহিত হয়। আবার ১৯৪৯ সালে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সর্বশেষ ১৯৯০ সালে স্নায়ুযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান সমগ্র দুনিয়ার নানা পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পুঁজিবাদী মিত্ররা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার একপক্ষীয় নেতৃত্বের আসনে বসে।

স্বাভাবিকভাবেই ১৯৯০ সালের পর বিশ্বব্যবস্থায় এক ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সূচনা হয়। এই সূত্র ধরে বিশ্বব্যাপী সামরিক অস্থিরতার কারণে নানা ধরনের যুদ্ধবিগ্রহের সূচনা ঘটে। যুগোসøাভিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া যুদ্ধের বিভীষিকায় বৈশ্বিক উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পায়। সংগত কারণেই বিশ্ব নেতৃত্ব প্রত্যাশী রাশিয়া ও চীন একপক্ষী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নানা ধরনের তৎপরতা গ্রহণ করে। গত ২৮ বছরের বিভিন্ন পরিক্রমা শেষে আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে বিশ্ব নানামুখী পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। মূলত ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ এবং ২০১৪ সালে ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র ক্রিমিয়ার রুশ সংযুক্তি সাম্প্রতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করে। যদিও এর আগেই ২০০৮ সালে রাশিয়া কর্তৃক জর্জিয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে সাউথ ওশেটিয়া ও আবজাখিয়ার স্বাধীনতা অর্জন ছিল বিশেষ ঘটনা। ওইসব সামরিক শক্তি প্রদর্শনীর বিপরীতে চীনের অর্থনৈতিক উত্থান, ল্যাটিন আমেরিকায় বামপন্থিদের অগ্রযাত্রা বৈশ্বিক মার্কিন আধিপত্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এসব ঘটনার আলোকেই বিশ্বব্যবস্থার প্রত্যাশিত পরিবর্তনের আশঙ্কা জোরদার হচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। বিশেষ করে ইউরোপে অসংখ্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে দেশটি নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। যদিও রাশিয়া ও চীনকে মোকাবিলায় ইউরোপ আমেরিকার বৃহত্তর ঐক্যের বন্ধন হিসেবে সামরিক জোট ন্যাটো থাকে ফ্রন্টলাইনে। তিন দশক ধরে পাল্টা শক্তির অনুপস্থিতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব হয়েছিল নিরঙ্কুশ। এই সূত্র ধরে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক বিবর্তনসহ নানা ধরনের রূপান্তর সংঘটিত হয়। এ ধরনের ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক, বাণিজ্যিক রূপান্তরের প্রতিক্রিয়া ছিল রাশিয়া ও চীনের স্বার্থ বিঘেœর কারণ হয়ে ওঠে। সংগত কারণেই রাশিয়া ও চীন নিজ নিজ মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে একটি আলাদা ব্যবস্থা তৈরি করতে সচেষ্ট হয়; যা বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা নামক ধারণার জন্ম দেয়।

এ বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার ধারণাকে ভিত্তি করেই ভাবা হচ্ছে আগামী বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কথা। একপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার চাপে সৃষ্ট যুদ্ধবিগ্রহের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সব পক্ষের কাছেই ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মূলত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির বৈশ্বিক চাহিদা। এ পর্যায়ে মস্কো সিরিয়ার শাসক আসাদের পক্ষে সরাসরি সামরিক সমর্থন দেওয়ার ঘটনাটি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার জন্য বড়সড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে সিরিয় বাহিনীর বিজয় ও প্রেসিডেন্ট আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। যা সিরিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে পশ্চিমা আক্রোশের নৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। শুধু এ ঘটনার কারণেই পাল্টে গেছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সামরিক চিত্র। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক কৌশলে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে ইসরায়েল। অন্যদিকে রাশিয়ার এস-৩০০, ৪০০ নামক এ প্রযুক্তির কাছে প্রায় অসহায় হয়ে পড়েছে পশ্চিমা অস্ত্রগুলো।

এ ধরনের বাস্তবতা ছাড়াও পূর্ব ইউরোপ ও ইউরোপ ঘিরে রুশ-মার্কিন রণকৌশল এখানে প্রণিধানযোগ্য। ইতোমধ্যে পূর্ব ইউরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে ভিন্ন সামরিক প্রেক্ষাপটের অবতারণা করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে বৈশ্বিক সামরিক কৌশলে এগিয়ে থাকতে চেয়েছিল দেশটি। যা ছিল রাশিয়ার জন্য মারাত্মক হুমকি। এর আগে ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তা-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আবার বেক্সিটের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর বিভাজন বৃহত্তর আটলান্টিক্সের ঐক্যের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। যে কারণে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমেরিকা ইউরোপ সম্পর্কের যেকোনো বিচ্যুতি বিশ্বব্যবস্থায় সম্ভাব্য পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে।

এদিকে এশিয়া প্যাসিফিকে চীনের শক্তি বৃদ্ধির অব্যাহত প্রচেষ্টাও আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসী সামরিক কৌশল বৈশ্বিক স্থিতাবস্থার জন্য বড় হুমকি হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। যদিও দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিছুটা উন্নতির দিকে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার নীতিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত রাখার প্রচেষ্টা। মূলত এ ঘটনার সাফল্য-ব্যর্থতার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল বৈশ্বিক মার্কিন নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ। প্রশ্ন হচ্ছেÑ যুক্তরাষ্ট্র এ নেতিবাচক অবস্থা নিজের নেতৃত্বের পূর্বাবস্থায় ফেরাতে পারবে কি না? অন্যদিকে এ বাস্তবতার মধ্যে বিশ্বে আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা থাকছে। বিশ্বব্যাপী দুই পক্ষের ব্যাপক রণ প্রস্তুতি এ শঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই যুদ্ধ কিংবা অন্য যেকোনো প্রক্রিয়াতেই বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন হতে পারে। আর এ পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব আসন থেকে নেতৃত্ব হারাতে পারে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। যদিও দেশটি নিজের নেতৃত্ব ধরে রাখতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমেরিকা ব্যর্থ হলে বিশ্ব আসনে রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close