রেজাউল করিম খান

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বিশ্লেষণ

কোন গন্তব্যে বাংলা ভাষা

মাকে ভালোবাসেন না, এমন পাষন্ড ভূ-ভারতে আছে বলে মনে হয় না। ভূ এবং ভারত এ দুই শব্দের মধ্যে ভারতকে বোঝাতে চেয়েছি। প্রশ্ন আসতে পারে শুধু ভারত কেন, সমগ্র দুনিয়া নয় কেন? মা কি কেবল ভারতবর্ষের মানুষের কাছেই পূজনীয়? না, বিষয়টি তা নয়। সন্দেহ নেই, সবাই মাকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা-ভক্তি করেন। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এই যে, এ জনপদের মানুষের কাছে মা একটি ন্যায়ের প্রতীক, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। মাকে অনুসরণ করেই বেড়ে ওঠা। সেই মা যা বলেন, যা শেখান, তা থেকেই শিশুর শুরু। শুরু মুখের ভাষা, মা বলতে শেখা। অতঃপর সমগ্র জীবন মায়ের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। পৃথিবীর, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার আর কোনো জাতি-গোষ্ঠী মাকে এমনভাবে আঁকড়ে থাকে বলে জানা নেই। সেখানে শেষ বয়সে মায়ের কষ্টের শেষ থাকে না। আমাদের মা একটি আবেগময় নাম। তাই মা এবং মায়ের ভাষা আমাদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। মায়ের ভাষা বাংলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি এবং উৎকণ্ঠাও। আবুজাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতায় কবি এক দুখিনী মায়ের চিত্রকল্প এঁকেছেন। মায়ের আদরের সেই খোকাটির আর বাড়ি ফেরা হয় না। অথচ ঘরে প্রতীক্ষায় কাতর মা ছেলের জন্য শখের উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে, নারকেলের চিড়ে কোটে। একসময় কুমড়োফুল শুকিয়ে যায়, ঝরে পড়ে কিন্তু খোকা ছুটি পায় না।‘... চিঠিটা তার পকেটে ছিল/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা/ মাগো, ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে/ তাইকি হয়?/ তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।/ তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে/ তবেই না বাড়ি ফিরবো..’ ঝাপসা চোখে ভাষা আন্দোলনে শহীদ ছেলের জন্য মায়ের প্রতীক্ষা যে কত তীব্র, কত কষ্টের তা বিবৃত করেছেন। এই কবিতায় গ্রামের ফুল-মাটি-জল হওয়ায় পাঠকদের চোখে বারবার একজন প্রতীক্ষা কাতর ক্লান্ত সহজ সরল মায়ের ছবি ফুটে ওঠে। বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে লেখালেখি কম হয় না। এ বিষয়ে নানাজনের নানামত আছে। আছে শঙ্কাও। এর যথার্থ কারণও আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যে বিচিত্র ভাষায় কথা বলেন, তার তুলনা মেলা ভার। এর মধ্যে যত মূল্যবান উপাদানই থাক না কেন, একে প্রকৃত বাংলা বলা যায় না। আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশের ফলে এক ধরনের নতুন ভাষা সৃষ্টি হচ্ছে। টিভি ও রেডিও অনুষ্ঠানে কী কী থাকবে, গত বছর ফেসবুকে তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন শিবলী আহমেদ, ‘টিভি : হাইগাইজ, ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে উপলক্ষে আমাদের টিভি চ্যানেলে থাকছে দিনব্যাপী এক্সক্লুসিভ সব আয়োজন। সো, কিপওয়াচিং।’ রেড্যু : ‘হেই হেই হেই ফ্রেন্ডস, কেমন আছো সবাই? ইউ নো, টুডে ইজ অ্যা গ্রেট ডে, সো, আমাদের আড়াই পয়েন্ট ও এফএম এ থাকছে হার্ট টাচিং সব সংগস। বাই দ্য ওয়ে, তোমরা তোমাদের রিকোয়েস্টের সং শুনতে পারো, সে ক্ষেত্রে আমার কাছে টেক্সট করো। ‘আর আর এস’টাইপ করে স্পেস দিয়ে লিখে দাও তোমার পছন্দের গানটি আর সেন্ড করো ‘থ্রি ও সিক্স ও’-এই নম্বরে।’ এসব দেখে শুনে দর্শক-শ্রোতাদের মন্তব্য : ‘ওহ্ নো! হাউ স্টুপিড! আজ ভাষা দিবসেও এরা বাংলায় টক করছে না। স্ট্রেইঞ্জ!’ শুধু রেডিও-টেলিভিশনই না, সংবাদপত্রেও ভাষার ব্যবহারে ভুলত্রুটি কম থাকে না। এবার দেখা যাক ফেসবুকে কী লেখা হচ্ছে, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় বিপ্লব নামের

একজনের মৃত্যু হয়েছে।’ ‘কৃষ্ণকায়া পাখিটা,,,, দৃষ্টাকর্ষী, মায়াময়ী,... স্মিত হয় মনটা,...।’ ‘বিচারপতি আফজাল হোঃ আহ এর বড় ও সাবেক চেঃম্যান আজগার হো আহঃ এর ছোট ভাই মারা যান।’

নানা স্থানে যা-ই বলা বা লেখা হোক না কেন, বাংলা ভাষার প্রতি দরদ ও মমত্ববোধ কারো কম নেই। সেই কারণে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে ও এই প্রজন্মের কারো আপত্তি থাকার কথা না। ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনকে সাধারণ বিচারে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলা হয়ে থাকে, হয়তো এ কারণে যে আন্দোলনের বিষয় ভাষা। ভাষার অধিকার দাবি। কিন্তু এ দাবির তাৎপর্য বিচার করতে গেলে আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাতে এমনও মনে হতে পারে যে, ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হওয়ার কারণে এর রাজনৈতিক চরিত্রই প্রধান।’ রাজনীতি সচেতন ভাষাপ্রেমী ছাত্রসমাজ, তরুণ ও যুবসমাজের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি ওঠে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’ ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু করো’। সেøাগান তিনটির তাৎপর্য অনুধাবন করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এসব উচ্চারণের পেছনে রয়েছে একটি জাতিসত্তার নানাবিধ অধিকার নিশ্চিত করা, সমাজের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করা, সর্বোপরি জনগণের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এসব প্রাপ্তির জন্যই তো বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান চাওয়া, পাকিস্তানের পক্ষে একচেটিয়া ভোট দেওয়া। এ নির্জলা সত্য পাকিস্তানি শাসকদের উপলব্ধিতে ছিল না। তাই তারা পূর্ববঙ্গকে শাসন-শোষণ করার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নীতিই সত্য হিসেবে গ্রহণ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার এ দাবির বহুমাত্রিক চরিত্র উপলব্ধি করে হোক অথবা নিছক মাতৃভাষা প্রেমে

হোক অথবা এ দ্বিবিধ কারণের সমন্বিত বোধে হোক, বাঙালি তরুণ ও যুবসমাজই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে

প্রথম পথে নামে, তাদের পেছনে শুরুতে সামান্যসংখ্যক নানাস্তরের শিক্ষিত বাঙালি শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক বা অন্য পেশাজীবী মানুষ ছিলেন।

১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস পরিণত বয়সের কমবেশি প্রায় সবারই জানা আছে। পরবর্তীকালে বাঙালির জীবনে এর প্রভাব সম্পর্কেও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এ কথা সবাই স্বীকার করেন যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা সংগ্রামের সূচনালগ্নেই। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নেই প্রথম বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। আটচল্লিশেই মহম্মদ আলী জিন্নাহ্র সামনে একদল ছাত্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বাঘের মতো গর্জে ওঠেন ছাত্ররা। সেই গর্জনই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা পূর্ব বাংলায়। এরপর আসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। ছাত্রদের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়। শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি ও বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ছাত্ররা রাস্তায় নামেন। চালানো হয় গুলি। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। না, অসমসাহসী সেই তরুণদের রক্ত বৃথা যায়নি। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্থান দেওয়া হয়। আর এখন দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃত। পালিত হচ্ছে সারা দুনিয়ায়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close