সফিউল্লাহ আনসারী

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

ভাষার মূল্যায়ন ও অবমূল্যায়ন

আমার মুখের ভাষা, আমার মাতৃভাষা, আমার প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা। এই ভাষার জন্য দিতে হয়েছে রক্ত, বিলাতে হয়েছে তাজা প্রাণ। রক্তের দামে কেনা মায়ের ভাষা আমার বাংলা। আমার বাংলা, আমার দুখিনী বর্ণমালায় গাঁথা মালা। বিশ্বের ইতিহাসে কোনো জাতি বা গোষ্ঠী তাদের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে এমনটি হয়তো নেই। কিংবা সংগ্রাম আন্দোলন করতে হয়েছে এমনটিই খুবই কম অথচ আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য দিতে হয়েছে বুকের তাজা রক্ত। কিন্তু হায়! এত ত্যাগ আর জীবনের বিনিময়ে পাওয়া মুখের ভাষা আজ চোখের জলে ভেজায় তার জমিন। ৮ ফাল্গুনকে ভুলে আমরা অমর ২১ পালন করি। কেন? একই সঙ্গে কি বাংলা তারিখ-মাস এবং ইংরেজি তারিখ-মাস লেখা এবং বলা যায় না? একুশ এখন বিশ্ববাসীর এটা গর্বের, যে বাংলার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম জীবন বলিদান, সেই বাংলা তারিখ ৮ ফাল্গুনকে কেন ভুলে যাই? সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা আর আমাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করলেই আমরা একই সঙ্গে আট ফাল্গুন আর একুশকে অমর করে স্মরণ করতে পারি।

রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতরা কি ভাষার অবমূল্যায়ন আর অপব্যবহারের জন্য জীবন দিয়েছিল? কথা হচ্ছে, বাংলা ভাষার শত্রু-মিত্র; আমরা হুজুগে জাতি বলেই অন্য বিষয়গুলোর মতো বাংলা ভাষার শত্রু-মিত্র চিনতে পারি না কিংবা ভুল করি। ভাষার ব্যবহারে ভিনদেশি ভাষার মিশ্রণ আমার মায়ের ভাষা বাংলার ১২টা বাজাচ্ছে, সেদিকে নেই কোনো খেয়াল। বিশ্বের সব ভাষাকে সম্মান করেই বলছি, আগে আমার মাতৃভাষার ব্যবহার, তারপর অন্য ভাষা। যদি বাংলাতেই থাকে ব্যবহৃত শব্দ তবে ভিনদেশি ভাষা কেন?

আমরা জানি, ভাষার জন্য সংগ্রাম শুধুই মুখের ভাষার জন্য হয়নি; হয়েছে স্বতন্ত্র বর্ণমালার জন্যই। বাঙালির ভাষাকে হত্যা করার পাশাপাশি অক্ষরগুলোকেও নিঃশেষ করারও চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। আমাদের সূর্য সন্তানরা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রকেই একসঙ্গে মোকাবিলা করে প্রতিরোধ যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে, রক্ষা পেয়েছে আমার ভাষা বাংলা। আমার বাংলা বর্ণমালাকে হারতে দেয়নি বিজয়িনী মা, দিয়েছে বলিদান তার গর্ভে জন্ম দেওয়া সন্তানকে। সেই সন্তানরা আজ প্রতিযোগিতায় মেতেছেন বাংলা বিদ্যালয় ছেড়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে। চেতনার এ করুণ অবস্থার জন্য দায়ী কারা? আমরা না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা? আজকে সে বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। এক দেশ, এক মানচিত্র, একটি পতাকা, তবে একটি ভাষা এবং একই শিক্ষাব্যবস্থা নয় কেন?

ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ যারা বাংলার পক্ষ নিয়ে ছিলেন, তাদেরকে ভারতের দালাল, হিন্দু ইত্যাদি বলা হয়েছিল সেদিন অথচ আজ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন ভাষা অজ্ঞাত শত্রুকবলিত! আমাদের দেশের অফিস-আদালত থেকে শুরু করে আজও আরবি, ফারসি, ইংলিশসহ হিন্দি ভাষার দখলদারিত্ব বিদ্যমান। বিশেষ করে আমাদের বিচারব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ভিনদেশি ভাষা। কোনো অজানা কারণে সরকারের ঊর্ধŸতন কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা অজ্ঞাত।

বাংলা এখন শুধুই বাংলাদেশের মানচিত্রেই সীমাবদ্ধ নেই, বিশ্বের সব দেশে স্বীকৃত ভাষা হিসেবে গর্বিত বাঙালির মাথা উঁচু করেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে জাতিসংঘের আয়োজনে। আমরা স্বাধীনতার গৌরবের আগেই পাওয়া ভাষার বিজয়কে সমুন্নত রাখতে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাকে আরো অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারি। বিশ্বে বাংলা ভাষার সম্মানে প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য, তারা এখনো বাংলাকে আমার ভাষাতে এগিয়ে নিতে বেশি করে অবদান রাখতে পারেন।

ফেব্রুয়ারিতে ভাষার প্রতি ভালোবাসার সঙ্গেই বেড়ে যায় আমাদেরও মাতামাতি, এই সম্মান ভাষার প্রতি, শহীদদের প্রতি আমাদের চেতনাদ্বীপ্ত টান। একুশে বইমেলা বাংলা ভাষার আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে লেখক-পাঠকের মিলনমেলাকে অর্থবহ করে তোলে। আমরা অমর একুশের গান গাই, শহীদ মিনারে নগ্ন পায়ে ফুল দেই, সভা-সেমিনার আর কাব্যের মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখি পুরো মাস অথচ ভুলে থাকি ৮ ফাগুনকে। বাংলা ভাষার জন্য দিবস পালন হয় ইংরেজি তারিখ আর মাস ঘিরে। এটা কষ্টের এবং ভাবনার বিষয়। আমরা খাঁটি বাংলা ভাষাভাষী হয়েও চরম অবহেলায় বাংলাকেই আজ করে যাচ্ছি ছোট। বিদেশি ভাষা আর ভিনদেশি চ্যানেলে দাপটে আমাদের বিদ্যালয় পড়া ছেলেটাও কথা বলছে জগাখিচুড়ি ভাষায়। আল্টামর্ডান হতে গিয়ে উল্টা মডার্ন হয়ে আমরা ছুটছি অজানায়। এফ রেডিওতে ইংলিশ-বাংলা-হিন্দির মিশেলে ভাষাকে করা হচ্ছে দুর্ভেদ্য, চরম অপমান। বাংলা ভাষা মুখে নিয়ে জন্ম হওয়া একজন বাঙালির এই দেশে মাতৃভাষার অবহেলা একটি অমার্জনীয় অপরাধ। ভাষার প্রতি দরদ শুধু একটি দিনে সীমাবদ্ধ

করে সারা বছর ভাষার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সচেতনতার পাশাপাশি ভাষার প্রতি অগাধ

ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, সর্বক্ষেত্রে সঠিক বানান ও উচ্চারণের ব্যবহার করে আমাদের বাংলাকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে।

দুঃখের বিষয় হলো, অসচেতনতা আর হুজুগে বাঙালির দোষ দিয়ে কী হবে? যেখানে সরকারি অনেক নীতিমালা ইংরেজিতে খসড়া হয়। বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য সরকারের যে আন্তরিকতার অভাব তা ইংরেজির ধারস্থ হওয়াতেই বোঝা যায়। তবে আশার কথা, ইদানীং মোবাইলে বাংলা অবাধ ব্যবহার এবং অনলাইন পোর্টালে বাংলায় সংবাদ ও তথ্য আদান-প্রদান পাঠককে উৎসাহিত করেছে। এটা আশার আলো ছড়ালেও সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার আশা করা যায় না। ইংরেজি থাকুক, তবে বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়।

‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সনের ২ নং আইন) ৩’। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের

সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।

(২) ৩(১) উপধারায় উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বে-আইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।

(৩) যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন, তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।

স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বাংলা ভাষার বেহাল দশা । সময় এসেছে ভিনদেশি ভাষা ছেড়ে বাংলা ভাষাকে জীবন রষ্ট্রের সবখানে ব্যবহারের। আবারও বলি আমরা ভিনদেশি ভাষাকে আমার মায়ের ভাষার চেয়ে কম সম্মান করি না। কিন্তু রক্তের বিনিময়ে, জীবনের বিনিময়ে অর্জিত ভাষাকে যেন একবারও ভুলে না যাই। মননে, সৃজনে, চেতনায়, মুখে মুখে, অন্তরে, ভাবনায় বাংলা, বাংলা আর বাংলাকেই ধরে রাখি মর্যাদার শিখরে।

‘মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’র গৌরব যেন মøান না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি যেন থাকে সব সময়। বাংলা আমার মাতৃভাষা, অমর একুশ এখন বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত। ফাগুন মাস আমার জাতীয় জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মাস। বিশ্বের অনেক জাতির স্বাধীনতা দিবস থাকলেও নেই ভাষার জন্য দিবস। কিন্তু বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতা ও ভাষার জন্য দিবস রয়েছে। ফাল্গুন মাস বাংলা সনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস, যে মাসে ভাষা আন্দোলন এবং এর পরিপূর্ণতায় আমরা শহীদ দিবস পেলাম।

সেই অমর ৮ ফাগুন বৃহস্পতিবার বারবার ফিরে আসে অথচ আমরা তার কথা মনে করি না, স্মরণ করি না। মেতে থাকি শুধুই একুশ নিয়ে, ফাগুন নিয়ে কেন মাতি না? পলাশ শিমুলের এই লালে, ফাগুনের আগুনঝরা বসন্তে শহীদের রক্ত যেন সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ আর আন্দোলন গর্জে ওঠার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা অমর একুশ আর ৮ ফাগুনকে যেন একই চেতনায় ধারণ করে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করি। আজ এই প্রত্যাশার সঙ্গে স্মরণ করছি মহান ভাষাশহীদ ও ভাষাসৈনিকদের।

লেখক : কবি ও গণমাধ্যমকর্মী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close