আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮

নিবন্ধ

নারীশিক্ষা প্রসারে বেগম রোকেয়া

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বেগম রোকেয়া নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বাঙালি নারীদের অগ্রদূত বলা হয় তাকে। নারীদের মুক্তি ও শিক্ষা নিয়ে সংগ্রাম করেছেন, যা ছিল তার সময়ে অকল্পনীয় চিন্তা। আর বাস্তবায়নের চিন্তা কল্পনার বাইরে ছিল। পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে নারীদের বঞ্চনা ও অধিকার নিয়ে। তবে পুরুষকে পাশ কাটিয়ে একতরফা চিন্তা করেননি তিনি। এই মহীয়সী নারী ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। কাকতালীয়ভাবে তার মৃত্যু দিবসও ৯ ডিসেম্বর। ১৯৩২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন বাঙালি নারীদের এ অগ্রদূত।

ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও শ্লেষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যম-িত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তার রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তার প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিজ্ঞান সম্পর্কেও তার অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে আর আলোচনায়। তিনি নারীশিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অনেককে উৎসাহিতও করেছেন। মনে-প্রাণে চেয়েছেন নারীরাও সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাক। উন্নয়নে অংশগ্রহণ করুক। তিনি প্রায়ই বলতেন, নারীরা সমাজের অর্ধেক। তাই অর্ধেক অংশকে বাদ দিলে দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব না। তার এ আন্দোলন ছিল অহিংস। তবে কৌতুকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন নারীদের নিপীড়িত অধ্যায়। সাহিত্য জগৎ আর নারী মুক্তির সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণেই ২০০৪ সালে বিবিসি পরিচালিত ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বকে ডিঙিয়ে ৬নং তালিকাতেই এসেছিলেন। এতেই বোঝা যায় বাঙালির মধ্যে তাঁর প্রভাব কত!

১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ভারতের বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বেগম রোকেয়া বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাখাওয়াত ছিলেন উর্দুভাষী কিন্তু মুক্তমনা। বেগম রোকেয়াকে তিনিই লেখালেখি করতে উৎসাহিত করেন। বিয়ের পর রোকেয়ার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ালেখা পুরোদমে শুরু হয় এবং সাহিত্যচর্চার পথটাও তার জন্য খুলে যায়। বিয়ের পর তার নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন হয়ে যায়। সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিস¤পন্ন। উদার ও মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান এবং ক্রমেই ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০৯ সালের ৩ মে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। ১৯০৪ সালে বেগম রোকেয়া রচিত করেন মতিচুর নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। এ প্রবন্ধ গ্রন্থে রোকেয়া নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে নারী-পুরুষকে সমাজ উন্নয়নে আসার আহ্বান করেছেন। এখানে নারী পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ যে নারীশিক্ষার অভাব, তা বলেছেন এবং বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। পরের বছর আর একটি গ্রন্থ লেখেন। নাম সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫)। এ বইতে নারীবাদী ইউরোপিয়ান সাহিত্যের ক্লাসিক ধারা লক্ষ্য করা যায়। এ গ্রন্থটি শুধু বাঙালির নয় সারা বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্য বলে মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। আর পদ্মরাগ (১৯২৪) তার রচিত উপন্যাস। অবরোধবাসিনীতে (১৯৩১) তিনি পর্দাপ্রথা ও অনেক বিষয়ে ইতিবাচক- নেতিবাচক বা তার চিন্তাভাবনা বিদ্রƒপবাণে তুলে ধরেছেন এ দুটি গ্রন্থে। রোকেয়ার প্রবন্ধ বা সাহিত্যকর্ম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

বেগম রোকেয়া সাহিত্যকর্ম বা আলোচনার মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না, তা বলেছেন। বাংলাদেশে তিনি বিপুল জনপ্রিয় অর্জন করেছেন তার লেখনী ও চিন্তাভাবনা আর কর্ম দিয়ে। বাংলাদেশ ও বাঙালি তাকে স্মরণ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে। নারীর কথা আসলেই আলোচনা, সেমিনার, বক্তব্য বা আড্ডায় তার নাম আগে চলে আসে। ছোট-বড় অনেক স্থাপনা তার নামে আছে। পাঠ্যপুস্তকে বা গবেষণা কাজে তার জীবনী আলোচনা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বলা যায়, নারী সমাজের আলোকবর্তিকা হিসেবে দিশারি হয়ে আছেন এ মহীয়সী নারী।

বেগম রোকেয়ার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন ১৯০৯ সালে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও হাল ছাড়েননি। সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর ৫ মাস পর বেগম রোকেয়া ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ নামে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বলে রাখা ভালো, সে সময় মেয়েরা যে স্কুলে গিয়ে শিক্ষা লাভ করবে তা কল্পনা করা যেত না। এমনকি বাড়িতেও নারীশিক্ষা ছিল সুদূরপরাহত। কিন্তু কিছুদিন পর ১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে এসে ১৯১১ সালের ১৫ মার্চ কলকাতার ১৩ নম্বর ওয়ালীউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে তিনি আবার ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ চালু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় এখানে ছাত্রী ছিল ৮ জন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ধারণা ও জ্ঞান নিয়ে আসতেন। এসে তার প্রতিষ্ঠানে তার মতো করে প্রয়োগ করতেন। কঠোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতার ফলে চার বছরের মধ্যেই ছাত্রীসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪-তে। পরে ১৯৩০ সালের দিকে এটি একটি উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। তার এই অসামান্য কাজে মুগ্ধ হয়েছিলেন সরোজিনী নাইডু। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী। বেগম রোকেয়াকে এ ব্যাপারে প্রশংসা করে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘কয়েক বছর ধরে দেখছি আপনি কি দুঃসাহসের কাজ করে চলছেন। মুসলিম বালিকাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আপনি যে কাজ হাতে নিয়েছেন এবং তার সাফল্যের জন্য দীর্ঘকালব্যাপী যে কাজ হাতে নিয়েছেন, তা বাস্তবিকই বিস্ময়কর।’

১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তার বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষাবিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। নারীশিক্ষার প্রসারে বেগম রোকেয়া আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছেন। নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, ভোটাধিকারের জন্য লড়াইটা শুরু করেছিলেন বেগম রোকেয়া।

তার লেখায় চিন্তাভাবনা ফুটে উঠেছে। তিনি লেখেনÑ ‘মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে তাহারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীরূপে পরিচিত হইতে পারে।’ তিনি কখনোই পুরুষকে ছোট করে দেখেননি। তাই তো তিনি লিখেছিলেনÑ ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।’

তিনি আরো লেখেন, ‘দেহের দুটি চক্ষুস্বরূপ, মানুষের সব রকমের কাজকর্মের প্রয়োজনে দুটি চক্ষুর গুরুত্ব সমান। তিনি নারী ও পুরুষকে একটি গাড়ির দুটি চাকার সাথে তুলনা করেছেন। কেননা একটি চাকা ছাড়া পুরো গাড়িটাই অচল। তাই নারী ও পুরুষ যদি মিলেমিশে কাজ করে, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবেই। সমাজের অর্ধেক অংশকে বাদ দিলে কখনোই রাষ্ট্রের উন্নতি হবে না। তাই তো তিনি ছিলেন সমতায় বিশ্বাসী। মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার সমাধি উত্তর কলকাতার সোদপুরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে আবিষ্কার করেন। বেগম রোকেয়া আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার অহিং আদর্শ আমরা মেনে চলতে পারি।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close