রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২০ নভেম্বর, ২০১৮

পর্যালোচনা

সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিক দায়

আমাদের জীবনের সময় সীমিত। সীমিত সময়ের মধ্যে আমাদের অনেক কাজ করতে হয়। সমাজ, সংসার, ধর্ম, কর্মÑসব এই সীমিত সময়ের মধ্যেই করতে হবে। কাজেই সুন্দর কাজ আগে করা দরকার। বারবার ভুল কোনো কাজ করে তা সংশোধন করা অনেক কঠিন। অন্যদিকে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করে কী লাভ অর্জন করা যাবে জানি না। জীবনে আগে বাঁচতে হবে। জীবিত থাকলে অনেক ভালো কাজ করার সুযোগ আসবে। জীবনে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা জরুরি। জীবন মানেই তো সুন্দর। সুন্দর জীবনের চিন্তাও সুন্দর হোক। মরার আগে মরতে চাই না। বাঁচা মানে চিন্তা ও মননে সতেজ থাকা। যারা জীবনমৃত, আমি সে দলের বাইরে থাকতে চাই। মানুষ ততক্ষণই জীবিত, যতক্ষণ সে সত্য-মিথ্যার ব্যবধান করতে পারে। অসত্যকে জীবনের অনুষঙ্গ করা মানে এক ধরনের আত্মহত্যা। আমাদের সমাজে অসত্যকে জীবনের সারথি হিসেবে মেনে নেওয়ার সংখ্যাই বেশি। অর্থাৎ আত্মহত্যার পথে চলমান, জীবনমৃত মানুষের সংখ্যাই বেশি। মিথ্যার জয় জয়াকার। কিসের কারণে মানুষ আজ অন্ধ, বধির ও বোবা। একজন মানুষ একবারই এ বিশ্ব চরাচরের বাসিন্দা হয়। এখানে দ্বিতীয়বার আর আসার সুযোগ নেই। যত দিন জীবন আছে, প্রাণ আছে, আত্মা আছে, বোধশক্তি, চেতনা আছে, সত্যের সাধন করা আবশ্যক। অসত্য জীবন নয়। মানুষ হিসেবে মানবীয় দায় অসীম। বাবার কাছে সন্তানের দায় যেমন অনিবার্য, আবশ্যক। সমাজ রাষ্ট্রের কাছেও নাগরিকের দায় তেমনি। মানুষ নিজের চেষ্টায় পরিবার থেকে সমাজে বসবাস করার সব উপকরণ তৈরি করেছে। নিত্যনতুন আবিষ্কার দ্বারা জীবনকে আরো সহজসাধ্য করেছে। করে চলেছে। নিজের প্রয়োজন অনুসারে নির্মাণ করছে যতসব আইন, কানুন, সমাজ ও রাষ্ট্র।

মানুষ সমাজে এ আইন-কানুন তৈরির পশ্চাতে একটা কারণ ছিল, তাহলো মানুষ যাতে তার নির্মিত সমাজের ভেতর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকে। শৃঙ্খলা বজায় থাকে। এই শৃঙ্খলার বিধান অত্যন্ত জটিল; কেননা আদিকালে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বিধান ছিল না। মানুষ প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। সমাজে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশল ছিল সহজ-সরল। মানুষের জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করেছে। এই সংগ্রাম থেকেই মানুষ উদ্ভাবনী ক্ষমতা অর্জন করে। কাঁচা মাংস খাওয়া মানুষ যখন আগুন জ্বালাতে শিখে, তার জীবনের বিশাল পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন মানুষের অভ্যাসকে বদলে দেয়। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন মানুষ শিখে যায় এখানে। এই খাদ্যাভ্যাস প্রথম মানুষ আর বনের পশু থেকে আলাদা করে দেয়। ইতিহাসের আলোকে মানববিজ্ঞানীরা মানুষের চিন্তাচেতনা ও মগজ বিকাশের সঙ্গে যে বর্ণনা দেন, তার সঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাস অনেকটা দায়ী। মানুষের মগজের আকার অনেকটা বড়। বলা হয়, মানুষের মগজ মানুষের আকারের অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় প্রায় ৯ গুণ বড়। এই মগজের আকার নাকি চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশ দ্রুত কাজে আসে। অন্যান্য প্রাণী নিজেরা দলবদ্ধ জীবনযাপন করার অনেক উদাহরণ আছে সত্য কিন্তু মানুষের দলবদ্ধতার সঙ্গে তার তুলনা হয় না। কেননা মানুষ তার সন্তানকে ভক্ষণ করে না। তাকে মানুষ হিসেবে সমাজে বিকাশ লাভে সহায়তা করে। তারে শিক্ষা দেয়, সামাজিকায়ন করে। ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে। কিন্তু এমন নজির যখন আমরা দেখি, সন্তান তার বাবা-মাকে হত্যা করছে। কিংবা বাবা-মা তার সন্তানকে হত্যা করছে। তাহলে সমাজের উন্নতি, বিকাশ, বুদ্ধিভিত্তিক অগ্রসরতা আমাদের কী কাজে আসছে?

এই প্রশ্ন করা যেতে পারে বৈকি। কেন এই মানসিক বৈকল্য? মানুষ যখন তিন-চার বছরের শিশুর ওপর পাশবিক নির্যাতন করে, তখন সেকি নিজেকে আর মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার দাবিদার? নাকি সে নরপশু? এই নরপশুরা সমাজে বাস করলে, বুক চেতিয়ে হাঁটাচলা করলে অন্য সাধারণ নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশুদের মনে কী দাগ পড়ে, তা কীভাবে বোঝানো যাবে, আমার কাছে কোনো শব্দ বা ভাষা নেই। যে মানুষের ভেতরে একটা মনুষ্যত্ব থাকে, তা মরে যাচ্ছে। কাজেই জনসংখ্যা বাড়লেও মানুষ কমে যাবে। জন্মের সময় যেহেতু মানুষ শুধু মানবের আকৃতি পায়। অবুঝ থাকে। শিশু নিষ্পাপ থাকে। তার মন-মেজাজ একেবারেই নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ। তার চিন্তার বিকাশ ঘটে অতিধীরে। তার পরিবেশ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ চারপাশে যা কিছু আছে, তার প্রভাব পড়ে এই শিশুর চিন্তন ক্রিয়ার মধ্যে। পরিবার, সমাজের যেসব উপাদান, সে প্রত্যক্ষ করে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার আচরণে। চিন্তাশক্তির প্রতিটি উপাদান পরিবেশ থেকে পাওয়া। আমাদের এ সময়ের পরিবেশ, সমাজ বা রাষ্ট্রের যে আচরণ বা প্রকাশ ঘটছে, তারই প্রভাবে শিশুরা আচরণ করছে। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, অনুপরিবারের বিকাশ, পরিবারে শিশুদের একা থাকা, কাজের বুয়া, আয়া দ্বারা লালন-পালন, অত্যধিক মাত্রার চাহিদার পেছনে বাবা-মায়ের দৌড়ানো সন্তানের প্রতি উদাসীনতা বেড়ে যাওয়া, আজকাল আবার যোগ হয়েছে টিভি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার। সব মিলিয়ে আমাদের সন্তানদের ওপর যে চাপ পড়ছে, এতে সন্তানদের মধ্যে সামাজিকতার প্রতি এক ধরনের উন্নাসিকতা তৈরি হচ্ছে। তার নিজের কাছে নিজেকেই মনে হচ্ছে সেরা। সে মনে করছে আমার চিন্তাই সঠিক। আমিই সেরা। তার কাছে সামাজিক মূল্যবোধ, শ্রদ্ধা, সম্মান করা, অপরের প্রতি দরদ ইত্যাদি মনে হয় উধাও হয়ে যাচ্ছে।

সমাজ কাঠামোর ভেতরকার সংকট থেকেই আসলে জন্ম নেয় অপরাধ। কেননা মানুষের অপরাধপ্রবণতা আসে অন্য আরেকজনের অপরাধ করা দেখে। মানুষ যখন দেখে, একজন অপরাধ করছে তার বিচার হচ্ছে না। শাস্তি হচ্ছে না। বুক ফুলিয়ে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অপরাধীর দাপট আরো বেশি। সমাজের সাধারণ মানুষ নির্যাতনের ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। কেননা সে শান্তি চায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাদের দায়িত্ব, তারাই অহরহ আইন ভেঙে চলেছে। আইন নিজের হাতে নিচ্ছে। মানবিকতা বোধের চেতনা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, আইন-কানুন, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান, পরার্থপরতা ইত্যাদি যেন দিন দিন কিতাবি শব্দে রূপ নিচ্ছে। মানুষের মনের একটা খোলা জানালা আছে। এখানে ভালো যেমন উঁকি দেয়, মন্দও তেমনি উঁকি দেয়। দূরে ভালোটা দেখতে পায় আবার মন্দও দেখতে পায়। মন্দটা ভালোটার ওপর প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবের কাজটা করে আশপাশের পরিবেশ, শিক্ষা, মূল্যবোধ, সামাজিক কাঠামো, সবকিছু যা আমাদের জীবনকে তাড়িত করে। মানুষের ভেতরকার কুপ্রবৃত্তি জয় করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। অধিকন্তু সমাজে যদি ন্যায়বিচার না থাকে, শুধু মূল্যবোধ দিয়ে সমাজের মন্দ প্রতিরোধ করা যাবে না। আমাদের সমাজ অনেক অস্থির, এই অস্থির সমাজে মানুষের মধ্যে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করা আরো কঠিন। দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ জরুরি। আদিকাল থেকে মানুষ তার মুক্তির গান গেয়ে এসেছে। কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সমাজ, সংস্কারক, নবী-রাসুল, জ্ঞানীজন সবার একটাই উদ্দেশ্য ছিল সমাজ যাতে সুন্দর হয়। সমাজে ভালোবাসা, দয়ামায়া, পরের জন্য কিছু করা। আমার প্রতিবেশী ভালো থাকলে, আমি ভালো থাকব। এসব নীতি-আদর্শ গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করেছেন। এখনো করে যাচ্ছেন কেউ কেউ। তবু আমাদের সমাজে অনাচার-অত্যাচার, সামাজিক মূল্যবোধের এত অবক্ষয় কেন?

মানুষের মন অপরাধ প্রবণতায় ভরপুর। অপরাধ করার সুযোগ পেলেই মানুষ করবে। এখানে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, আইন এবং রাষ্ট্র একটা সামাজিক মন গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। এই সামাজিক মন সব মানুষ জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে। সামাজিক মনের কাঠামো হবে সুশীল,

সুচিন্তা, সুশাসন, সাম্য, সুনাগরিক হিসেবে মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করা। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত সামাজিক মূল্যবোধ গঠন করতে পারিনি। যে সামাজিক মূল্যবোধ সামাজিক নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার, স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। মানুষের মনের ভেতর যে আলাদা একটা সত্তা আছে, সেখানে ভারসাম্য দরকার। এই ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মননশীল কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখা দরকার। আজকাল সমাজে অস্থিরতা বিস্তার করার পশ্চাতে গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে বলে মনে করেন। আবার এর ভিন্নমতও আছে।

গণমাধ্যম সামাজিক সচেতনা তৈরি করতে পারে। এ নিয়ে কারো ভিন্নমত নেই। কিন্তু আজকাল আমাদের সমাজে অবাধ মিডিয়ার কারণে নানা অসামাজিক উপাদান সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এতে করে তাদের মনে যে প্রতিফলন হচ্ছে, তা হলো নিজেকে সেই চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা। এ কাজে ভিডিও গেম আমাদের শিশুদের মনে প্রভাব ফেলছে। এখন আবার ইউটিউব আমাদের দেশে অবাধ। এর মাধ্যমে অশ্লীলতার বিস্তার হচ্ছে। যেহেতু এসব উপকরণ অবাধে পাওয়া যায়। তাই তার প্রভাব দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সবকিছুর পেছনের সেøাগান হচ্ছে মানুষ শান্তি চায়।

লেখক : বিশ্লেষক, গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close