সাধন সরকার

  ০১ অক্টোবর, ২০১৮

পর্যালোচনা

টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ রোধসহ পরিকল্পিতভাবে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য প্রায় দেড় বছর আগে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে নেওয়া হয়। পরিকল্পিত, টেকসই ও আধুনিকভাবে সাভারের চামড়া শিল্পনগরী গড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সাভারের চামড়া শিল্পনগরী এলাকা ও এর আশপাশের পরিবেশ আগের মতো (হাজারীবাগ থাকাকালে যেমন হতো) একইভাবে দূষিত হচ্ছে! ট্যানারির দূষিত বর্জ্যে আগেও যেভাবে নদীদূষণ (বুড়িগঙ্গা) হতো, এখনো সেভাবে নদীদূষণ হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার সেই দুর্ভাগ্য চেপেছে এবার ধলেশ্বরী নদীর ওপর। কঠিন ও তরল বর্জ্য পরিশোধনের ক্ষেত্রে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে এখন ‘হ-য-ব-র-ল’ অবস্থা বিরাজ করছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনো কঠিন বর্জ্য ফেলার জন্য ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়নি। ফলে উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য (পশুর কান, লেজ, শিং, হাড়, লোম, চামড়ার কাটপিস, মাংসের ঝিল্লি ইত্যাদি) ডাম্পিং ইয়ার্ডের ভাগাড়ে ফেলা হচ্ছে। আবার বর্জ্যরে ভারে ও বৃষ্টিপাতে ভাগাড়ের বাঁধ দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে দেয়াল ভেঙে বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ছে। এ ছাড়া শিল্পনগরের তরল বর্জ্য ‘সিইটিপিতে’ পৌঁছানোর আগেই বিভিন্ন জায়গার পাইপলাইন উপচে বর্জ্য নালায় গিয়ে পড়ছে আর এই বর্জ্যরে শেষ ঠিকানা হচ্ছে নদী। ‘সিইটিপি’ থেকে ক্ষতিকর বর্জ্যমিশ্রিত যে পানি নদীতে ফেলা হচ্ছে, তাতে ক্ষতিকর উপাদান থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে ‘ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট’ চালু না করার ফলে ক্রোমিয়ামযুক্ত কঠিন বর্জ্য ভাগাড়ে ও এর আশপাশে রেখে দেওয়া হচ্ছে। ফলে পানির সঙ্গে মিশে তা আবার কোনো না কোনোভাবে নদীতে গিয়ে পড়ছে। তরল বর্জ্যরে ক্ষেত্রে পরিশোধনের পরও তাতে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ক্রোমিয়াম যেমন থাকছে, তেমনি বায়োকেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ডও (বিওডি) ঠিক রাখা যাচ্ছে না। নিয়ম মেনে ‘সিইটিপি’ চালু না রাখায় ট্যানারির বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ছে। পরিবেশ অধিদফতরসহ পরিবেশবাদীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনুযায়ী, বর্জ্য শোধনের পর যে পানি ধলেশ্বরীতে ফেলা হচ্ছে, তাতে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ ক্রোমিয়াম, ক্ষার, রাসায়নিক পদার্থ, লবণসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকছে। ফলে নদীর পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। দূষণের কারণে ধলেশ্বরীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। বিষাক্ত বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদীর পানির রং পাল্টে গেছে। নদীতে মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। বর্জ্যরে বিষক্রিয়ায় আশপাশের আবাদি জমির ফলনও কয়েক গুণ কমে গেছে। ফলে মাছ ও জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশপাশের পরিবেশ ও প্রাণিকুলের জন্য ধলেশ্বরীর পানি ধীরে ধীরে অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।

অথচ ট্যানারির তরল বর্জ্য এমনভাবে পরিশোধন করে নদীতে ফেলার কথা, যার ফলে নদীর কোনো দূষণ কিংবা ক্ষতি হবে না। নদী আমাদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই ধলেশ্বরীর দূষণ বুড়িগঙ্গাকেও ছাড়িয়ে যাবে! কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পরিকল্পনা না থাকায় ট্যানারির পাশের একটি অংশ রীতিমতো আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ট্যানারিশিল্পে কাজ করা শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে! এ শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মালিকপক্ষকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ট্যানারির দূষণ নিয়ে বহু বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ, নদ-নদীর দূষণ ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আগেও যে অবস্থা ছিল, বর্তমানেও সাভারের ট্যানারি শিল্পনগরীর অবস্থা তার থেকে খুব একটা উন্নতি হয়েছেÑতা বলা যাবে না। মালিকপক্ষ, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাই এর দায় এড়াতে পারে না। চামড়াশিল্প অন্যতম বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প। এতকাল পরও যদি এ শিল্পে পরিকল্পিত ও আধুনিক ব্যবস্থাপনার ছোঁয়া না লাগে, তাহলে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত আরোপের পাশাপাশি মুখ ফিরিয়েও নিতে পারে! সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ট্যানারির ‘টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশের ট্যানারির সুষ্ঠু, আধুনিক ও টেকসই ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া বিকল্প চিন্তা হিসেবে ট্যানারির সলিড বা কঠিন বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়া বা পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং) করে তা থেকে বিদ্যুৎ, আঠা, সার উৎপাদন করা যেতে পারে। ট্যানারির কঠিন বর্জ্য থেকে পৃথিবীর উন্নত দেশে বিভিন্নভাবে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে ভিন্ন কিছু উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে পরিবেশ দূষণও রক্ষা পাচ্ছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close