অলিউর রহমান ফিরোজ

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মতামত

ওষুধ বাণিজ্যে নৈরাজ্য

দেশের ওষুধ বাণিজ্য এখন বেপরোয়া গতিতে চলছে। এক শ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী অত্যাবশ্যক ওষুধ নিয়ে যেভাবে মুনাফায় মেতে উঠছে, তাতে শিউরে উঠতে হয়। তাদের ধরার জন্য এতদিন কোনো ধরনের আইনের প্রতিকার ছিল না। শুধু নীতিমালা দিয়েই বাণিজ্য চালানো হতো। মাঝেমধ্যে র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের কিছু জরিমানা করলেও, বড় ধরনের শাস্তি আইনের পরিসীমায় ছিল না। তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা জরিমানা গুনেও আবার একই বাণিজ্যে ফিরে গিয়ে অবলীলায় মানহীন এবং ভেজাল ওষুধের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সরকার ভেজাল এবং মানহীন ওষুধের জন্য কঠোর আইনের খসড়া করেছে। অচিরেই তাদের ওপর আইনের খড়গ নেমে আসবে; যা খুবই সময়োপযোগী হিসেবে বিবেচিত হবে। মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যক এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধে ভেজাল দেখলে গা শিউরে ওঠে। ভেজালকারীরা এতটাই বেপরোয়া যে, তারা দেশের আনাচে-কানাচে সরকারের অনুমোদনবিহীন ফার্মেসিগুলোতে জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতে বেশির ভাগ ক্ষতির শিকার হতে হয় গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষকে। আর তারা ভেজাল এবং লাইসেন্সবিহীন ওষুধের বড় চালানগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রির জন্যই মূলত টার্গেট করে থাকে। তবে শহরের অনেক দোকানেও মানহীন এবং ভেজাল ওষুধ রাখার খবর পাওয়া গেছে। সাধারণ একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভেজালকারীরা এসএমসির ওরস্যালাইন নকল এবং মানহীন অবস্থায় দেশের মুদি দোকানগুলোতে পর্যন্ত সয়লাব করে ফেলেছে। এগুলো বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে তৈরি করে অবিকল এসএমসির প্যাকেটের মতো মোড়কে বাজারজাত করছে। একটা স্যালাইন পাতলা পায়খানা এবং শরীরের পানিশূন্যতার জন্য অতি আবশ্যক। সেখানে আটা ও লবণমিশ্রিত পানি সারাদিন খাওয়ানো হলেও রোগ ভালো হবে না। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেজালের শিকার হয় নামি-দামি কোম্পানির গ্যাসট্রিকের ওষুধ। কারণ, বাজারে এ ওষুধগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভেজালকারীরা বেশির ভাগ ওষুধই মিটফোর্ড পাইকারি বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারা দেশে বাজারজাত করে থাকে। তাই সরকার ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ ও ভেজাল ওষুধ তৈরি, মজুদ, বিক্রি এবং আমদানি-রফতানিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টি দেশে রফতানি করছে বাংলাদেশের ওষুধ। অ্যালোপ্যাথিক আইটেমের ২০৮টি ওষুধ কোম্পানি তিন হাজার ৫৮৮ জেনেরিকের প্রায় ৩০ হাজার ব্রান্ডের বিভিন্ন ওষুধ বাজারজাত করছে। আবার খোলা বাজারে কোটি কোটি টাকার নকল এবং ভেজাল ওষুধ রয়েছে।

বিদেশে ওষুধ রফতানি করে দেশ প্রচুর বৈদেশিক

মুদ্রা আয় করছে। কিন্তু দেশে এতদিন শুধু একটা নীতিমালা দিয়ে ওষুধ বাণিজ্য চলত। তাতে ছিল নানা জটিলতা। তাই সরকার ওষুধে ভেজাল, অবৈধ মজুদ রাখলে বা প্রদর্শন করলে যাবজ্জীবন কারাদ- এবং ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ- করারও বিধান করে আইনের খসড়া প্রণয়ন করেছেন; অচিরেই তা আইনে পরিণত হবে।

মফস্বল জেলাগুলোতে কারখানা বসিয়ে সেখানে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ ভেজাল তৈরি করছে। তাতে কিছু লোভী ফার্মেসি মালিকরা বড় ধরনের কমিশন পেলেও ক্রেতা ঠকছিলেন ঠিকই। বিশেষ করে, শিশুদের ওষুধেরই আধিক্য বেশি থাকায় সেসব কোম্পানিগুলো এসব ওধুষেই এই অবৈধ প্রক্রিয়া চালাচ্ছে অধিক হারে। এসব ভেজাল ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় শিশুদের জীবন আজ বিপণœ হতে বসেছে। দেশে সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে কিছু বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। তারা প্রেসক্রিপশনে বিদেশি ওষুধের নাম লিখে দেওয়ার কারণে বাজারে সেসব ওষুধের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। আর সে চাহিদা অনুযায়ী ব্যাবসায়ীরা তা বাজারজাত করছে। যেমন, দেশে বক্ষব্যাধির ওষুধের মধ্যে সেরিটাইড নামে একটা ওষুধ আছে, যা আমেরিকা থেকে আনা হয়ে থাকে। তবে দেশের বাজারে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। বিশেষত, অ্যাজমায় ওষুধটি অত্যাবশ্যক। এখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা যখন সেরিটাইড ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন, তখন সে ওষুধ ছাড়া অন্যটি ব্যবহার করতে তাদের মধ্যে অনিহা দেখা দেয়। তবে হ্যাঁ, কিছু ওষুধ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। তা পাশের দেশ ভারত থেকে আনা হয়ে থাকে। মিডফোর্ড পাইকারি বাজারের মাধ্যমে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের নীতিমালায় বাইরের ওষুধ বৈধভাবে আনাটা অনেক জটিলতার বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে আনার কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। তখনই ওষুধগুলো অবৈধভাবে দেশের বাজারে ঢুকে পড়ে। আর এতে সরকারও রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। পাশের দেশ ভারত থেকে গ্ল্যাস্কোর তৈরি ইনু আমাদের দেশের প্রচুর পরিমাণে চাহিদা রয়েছ। কিন্তু তা আসে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে।

ওষুধের সবচেয়ে বড় বাজার মিটফোর্ডে মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মানহীন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ভেজাল ওষুধ জব্দ করে। তাতে একদিনের অভিযানেই ধরা পড়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকার ভেজাল ওষুধ। জনবল সংকটের কারণে ওষুধ অধিদফতরের পক্ষে সারা দেশে অভিযান চালানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তাই দেশের মানুষ ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্যে এতদিন নাকাল হচ্ছিল। ওষুধ হলো জীবন-মরণের খেলা। আর তা নিয়ে যারা খেলা করেন, বিত্ত-বৈভবের মালিক হনÑ তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া চলবে না। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে, বিভিন্ন হারবালের এমন ওষুধ রয়েছে, যার গায়ে লেখা মূল্য সাড়ে ৩০০ টাকা। তাতে বিক্রেতার কমিশনই ২৫০ টাকা। তাদের কোনো লাইসেন্স নেই। মফস্বলে কখনো অভিযান চালানো হলেই তারা ফার্মেসি বন্ধ করে সরে পড়ে। বর্তমানে ওষুধ নীতিমালাটি আইনের খসড়া অবস্থায় রয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধের আমদানির বিষয় যদি সহজ করা হয় তাহলে দেশের সরকার রাজস্ব পাবেন। নইলে চোরাপথে ওষুধ আসবেই। সরকার যদি ভেজাল ওষুধের সঙ্গে মানসম্মত ভালো ওষুধের বিষয়টি বুঝতে না পাড়েন, তাহলে দেশের মধ্যে জটিলতা তৈরি হবে। চাহিদাপূর্ণ বিদেশি ওষুধের জন্য নিয়মনীতির মাধমে আমদানির সহজ পথ তৈরি না করলে, সেই ওষুধই দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যে মানুষকে কিনতে হবে। তাতে দেশের সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে পড়বে।

আইনে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে ওষুধশিল্পের অগ্রগতি সাধনে বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি সনদ মিলেছে আমাদের; যা ওষুধশিল্পের জন্য অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে নতুন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হচ্ছে। এর নাম হবে ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি (এনআরএ)। প্রস্তাবিত সংস্থাটি ওষুধ নিবন্ধন ও কাঁচামাল নিশ্চিতকরণে কাজ করবে। আগে ওষুধের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হলেও শাস্তির বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। তাই বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। তবে আশার কথা, এবার ওষুধ আইনে সরকারের প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিবছর একবার ওষুধের দাম হালনাগাদ করতে পারবে। আর বিষয়টি অধিদফতরের ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে বিধায় ক্রেতারা দামের ব্যাপারে ইচ্ছা করলেই ওয়াকিবহাল হতে পারবে। দেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সংখ্যা হবে ২৮৫টি। ইউনানির ওষুধ ২২৩ এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধ থাকবে ৩৭০টি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ থাকছে ৩৯টি। তবে আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক এবং ইউনানি ওষুধকেও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

দেশের ফর্মেসিগুলোতে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। নতুন আইনে কঠোরতা থাকলেও মাঠ পর্যায়ে তদারকি না করা গেলে শক্ত আইনও কোনো ফলদায়ক হবে না। সে ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। ওষুধশিল্পে দীর্ঘদিনের জঞ্জাল দূরীভূত করতে হলে মাদকের মতো সাড়াশি অভিযানের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close