আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

মতামত

উত্তরবঙ্গের উন্নয়নবৈষম্য

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ অক্টোবর ২০১৭-এ প্রকাশিত Priliminary Report on Household Income and Expenditure Survey ২০১৬ অনুসারে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য হার যেখানে উচ্চ দারিদ্র্যরেখা অনুসারে ২৪ হয়েছে ৩ শতাংশ, সেখানে সব বিভাগের মধ্যে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্য হার সবচেয়ে বেশি ৪৭ হয়েছে ২ শতাংশ। উল্লেখ্য, Household Income and Expenditure Survey২০১০ অনুযায়ী রংপুর বিভাগে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪২ হয়েছে ৩ শতাংশ। সারা দেশে যখন দারিদ্র্যের হার কমছে, তখন রংপুর বিভাগে এটি বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক বিষয়।

স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে, ভাগ্যবানরা দেশের দক্ষিণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাস করে আর সবচেয়ে দুর্ভাগারা বাস করে উত্তরবঙ্গে। লালমনিরহাটে চাকরির সুবাদে এ কথা মেনে নিতে হয়। এখন কিন্তু ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে এ অঞ্চলে। মঙ্গা নেই বললেই চলে। বেশ কয়েকটা সেতু হয়েছে। কিন্তু আগের পিছিয়ে পড়া অংশ পূরণ করে উন্নয়নের মূলধারায় আসতে ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনা আছে উত্তরবঙ্গের রংপুর বিভাগের। শুধু টাকার অঙ্কে দরিদ্রতা নির্ণয় না করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে শনাক্ত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এ অঞ্চলের আছে অন্যতম বৃহত্তম লালমনিরহাটের বুড়িমাড়ী ও দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর। এ দুটো চালু আছে। আধুনিকায়ন করতে হবে। তেঁতুলিয়া পর্যটন এলাকা। এখানে স্থলবন্দরও আছে। এখানে রয়েছে অর্গানিক চা বাগান। তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে পড়বে কান্তজির মন্দির। বাংলাদেশের বৃহত্তম টেরাকোটার অনুপম ও নিদর্শন। তিস্তা ব্যারাজ আছে, আছে রামসাগর। ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছে পুরনো স্থাপনাসমূহ। উল্লিখিত স্থানের ব্যাপক পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে। লালমনিরহাটে আছে রেলের বিভাগীয় শহর। পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে লালমনিরহাটের বিমানবন্দর। দিনাজপুরের সুগন্ধি চাল আর জগদ্বিখ্যাত লিচু আছে। এ অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর আগের চাষ। চাল প্রক্রিয়াকরণ মিল। ধানের এলাকা বলা হয় দিনাজপুরকে। দেশের শাকসবজির বড় অংশ সরবরাহ করে এ অঞ্চল। ভাওয়াইয়া গানের জন্মভূমি। এ গানকে ছড়িয়ে দিতে হবে। শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।

সমস্যাগুলো রয়েছে কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা, অনগ্রসর শ্রেণিপেশার একটি অংশ (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী), খরাপ্রবণ এলাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আয়বৈষম্য প্রকট, নিচু এলাকা আছে। গাইবান্ধায় রয়েছে নদীভাঙন প্রবণতা। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ সত্ত্বেও এ ‘রাজনৈতিক দূরত্ব’ বিরাজমান, যে সেতু উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকা ও দেশের অন্য কৃষি-ব্যবসাকেন্দ্রগুলোর সংযোগ স্থাপন করেছে। আলোচ্য অঞ্চলের ৬০-৬৫ শতাংশ কৃষকই দরিদ্র, প্রান্তিক। উপরন্তু প্রকটভাবে তাদের পুঁজি ঘাটতিও রয়েছে। ফলে এসব কৃষক সবুজ বিপ্লøব প্যাকেজের ‘বীজ-সার- সেচ-যান্ত্রিকীকরণের আওতায় উচ্চফলনশীল জাতের (এইচওয়াইভি)’ প্রতিশ্রুতিতে একীভূত হতে ব্যর্থ হয়। রয়েছে মাত্র দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় (ভালো) নেই। পিছিয়ে পড়া এলাকায় শিক্ষার আলো জ্বালাতে হবে। রেলের লালমনিরহাট সেকশন খুবই অবহেলিত বলে মনে করা হয়। রংপুর বিভাগীয় শহর হলেও একটিমাত্র ট্রেন (রংপুর এক্সপ্রেস) ঢাকা যাতায়াত করে। জনশ্রুতি আছে, পূর্বাঞ্চলের বাদপড়া ক্যারেজ লালমনিরহাট সেকশনে এসে বিলাসবহুল হয়। লালমনিরহাট শহর রেলের আর বিমানবাহিনীর অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। শহরজুড়ে এ দুই বিভাগের জমি। আইনি জটিলতার কারণে লালমনিরহাট শহরের অবকাঠামো উন্নয়ন থেমে আছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলকারখানা নীলফামারীর সৈয়দপুরে। জনবল সংকট আর বাজেট স্বল্পতার কারণে ধুঁকছে এ কারখানাটি। অথচ একটি গ্রামকে এ কারখানাটিই দেশের শীর্ষ ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত করেছিল। বলা যায়, সৈয়দপুর রেলকারখানা ধুঁকছে না তোÑধুঁকছে এ এলাকার স্বপ্ন। এ জটিলতাগুলো সমাধানের জন্য দরকার সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাট বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার/যন্ত্রাংশ নির্মাণের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাস্তবায়ন দ্রুত শুরু করা দরকার। সরকার আন্তরিক। ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করলে কম বরাদ্দে ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু সিদ্ধান্ত দিলেই লালমনিরহাট ও নীলফামারী বা এ অঞ্চলের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রান্তিক শ্রেণি শনাক্ত করে স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি যাতে ওভারলেপিং (একই কাজ ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন দফতর) যাতে না হয়, সে জন্য আমাদের সতর্ক হতে হবে।

এখানকার জলবায়ু প্রধানত উষ্ণ ও মোটামুটি আর্দ্র। তবে কয়েক দশক ধরে স্বল্প বৃষ্টিপাত, ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। একদিকে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ। এ অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর বেশির ভাগই বর্ষা শেষ হওয়ার আগে শুকিয়ে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি, খরা, বৃক্ষনিধন, পানি সংকটসহ বিভিন্ন কারণে বরেন্দ্রের প্রাকৃতিক ভারসাম্য আজ নষ্টের পথে। এ অবস্থার জন্য যেমন প্রকৃতিকে দায়ী করা যায়, তেমনি মানুষও কম দায়ী নয়। কালের বৈরিতা আর মানুষের সীমাহীন অপরিণামদর্শিতা আজ এ অঞ্চলকে ঠেলে দিয়েছে চরম বিপর্যয়ের মুখে। এ অঞ্চলে কমছে বৃষ্টিপাত, বাড়ছে তাপমাত্রা। প্রকৃতির এই দুই অনুষঙ্গের বিপরীতমুখী অবস্থানে বসবাসযোগ্যতা হারাচ্ছে মানুষ ও প্রাণী। বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি উৎপাদনে। এ অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, যার সঙ্গে খরা পরিস্থিতি ও এর পুনরাবৃত্তি এবং চাষাবাদের জন্য পানির অপ্রতুলতার সম্পর্ক রয়েছে। খরার সময় কৃষি উৎপাদনে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমছে। এ অবস্থায় সেচকাজে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় এ অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির পুনঃসঞ্চয়ের চিত্রটিকে সংকটময় অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ডিসেম্বর মাসের শেষ নাগাদ উচ্চফলনশীল জাতের ধান গাছ ও অন্যান্য শস্য এবং শাকসবজি উৎপাদনে বেশি পরিমাণে ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রয়োজনীতা দেখা দেয়। অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নামতে থাকায় খাদ্যশস্য ও শাকসবজি উৎপাদনে নেতিবাচব প্রভাব ফেলছে। সেচকাজে পানি সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য সর্বোত্তম সেচব্যবস্থাপনার নীতি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এ অঞ্চলে খরার ভয়ানক প্রভাব মোকাবিলায় পানি সরবরাহ বৃদ্ধি, জুতসই পানি ব্যবস্থাপনায় জনসচেতনতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি করতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জলসম্পদ ব্যবহারের পরিকল্পনা, ভূ-উপরিস্থ ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম ভীষণভাবে জরুরি। সে লক্ষ্যে বিদ্যমান বন্যা, সামুদ্রিক বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

রংপুর অঞ্চলে শিল্পায়নে বাধার অন্যতম কারণ হলো জ্বালানি সমস্যা। এখানে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ অঞ্চলে বেসরকারি খাত বিনিয়োগে উৎসাহিত না হলে প্রথম দিকে সরকারি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধাসহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপন করতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা সুবিধা পান। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা ও এডিপিতে বাজেট বরাদ্দ রাখা। রংপুর ওয়াসা গঠন করা ও এডিপিতে বাজেট বরাদ্দ রাখা। আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস করতে গুণগত শিক্ষার সুযোগ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন ও মেয়েদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। রংপুর বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাড়াতে হবে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন/অনুমোদন দিতে হবে, কারিগরি শিক্ষার জন্য নেই মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চরাঞ্চলে সেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেখানে বিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন। আইটি পার্ক স্থাপন করা যেতে পারে। আইটি পার্ক, আইসিটি সহায়তা, ইনকিউবেশন সেন্টার হলে শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা প্রান্তিক শ্রেণিদের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করতে হবে। আর যেগুলো চালু আছে সেগুলো সমন্বয় করতে হবে। পর্যটনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাজারজাতকরণের সমস্যা এলাকায় প্রকট। আরো হিমাগার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বেসরকারি অংশকে উৎসাহিত করতে হবে।

বলা হয়, তিস্তা-ধরলা-করতোয়ার কোল বেয়ে যেমন বয়ে যায় জল, তেমনি বয়ে যায় সময়। কিন্তু ভাগ্য বদলায় না রংপুর বিভাগের মানুষের। আমরা চাই উন্নয়ন হবে এলাকারÑসামগ্রিক উন্নয়ন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কর্তৃপক্ষকে কিন্তু এ এলাকার জনগণকেই আকৃষ্ট করতে হবে! তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

উপ-পরিচালক (বিআরডিবি), লালমনিরহাট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close