মাহমুদ আহমদ
পর্যালোচনা
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না
শেষনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে এই পবিত্র মহররম মাসের ১০ তারিখে নির্মমভাবে কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। সেদিন প্রকৃত ইসলাম ও সত্যের জন্য হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে মাথা নত না করে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেছিলেন। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) সেদিন ন্যায় ও সত্যের জন্য আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা অনুকরণীয়। শিয়ারা বর্তমানে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের শোকে যে মাতম করে, তা আবেগতাড়িত ইবাদত ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের দিনকে স্মরণ করে যথার্থই লিখেছেন, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’ আমাদের হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ত্যাগের কথা স্মরণ করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে অন্যকে কষ্ট দিয়ে শোক প্রকাশের কোনো শিক্ষা ইসলামে নেই আর শোক দিবস পালনের কোনো অনুমতিও শ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) দেননি। তবে রাসুল করিম (সা.) মৃত ব্যক্তির জন্য মাত্র তিন দিন শোক পালনের অনুমতি দিয়েছেন আর মৃত স্বামীর জন্য স্ত্রীর পক্ষে চার মাস ১০ দিন ইদ্দতকাল পালনের নির্দেশ রয়েছে। পক্ষান্তরে শহীদে কারবালা হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বলে গেছেন, ‘আমি শহীদ হলে তোমরা আমার জন্য উহ্! আহ্! কর না, আঁচল ছিঁড় নাÑ বরং ধৈর্য ধারণ করে থাকবে।’
যদি ইসলামে শোক দিবস পালন করার কোনো বিধান থাকত, তাহলে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাত দিবসই শোক পালনের প্রধান দিবস হতো। কেননা, তিনিই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, ইহজগত ও পরজগতের অকৃত্রিম বন্ধু এবং মুমিনদের জন্য মহানবী (সা.)-এর ওফাত অপেক্ষা শোকের আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আমরা হুজুর (সা.)-এর ওফাত দিবস শোক দিবস হিসেবে পালন করি না। কারণ, তা ইসলামে জায়েজ না। আর হুজুর (সা.)-এর পরবর্তী সময়ে খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে তাবেইন ও মুজতাহিদ ইমামরা কেউ তা পালন করেননি। ইসলামে শোক দিবস পালন না করার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে অনেক রয়েছে। যেমন বদরের যুদ্ধে ১৩ জন, ওহুদের যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবি শাহাদত বরণ করেন এবং হুজুর (সা.)-এর চাচা সায়্যিদুশ শুহাদা হজরত আমির হামজা (রা.) ওহুদের ময়দানে নির্মমভাবে শহীদ হন। তার নাক-কান কেটে বিকৃত করা হয়। বুক চিড়ে কাঁচা কলিজা পর্যন্ত চেবানো হয়। এতে মহনবী (সা.) খুবই মর্মাহত ও শোকাভিভূত হন। এ মর্মান্তিক ঘটনার পর তিনি প্রায় আট বছর দুনিয়ায় ছিলেন। এ দীর্ঘ আট বছরে হুজুর (সা.) হজরত হামজা (রা.)-এর জন্য কোনো শোক দিবস পালন করেননি। এ ছাড়াও খোলাফায়ে রাশেদিনের তিন খলিফা হজরত ওমর (রা.), হজরত ওসমান (রা.), হজরত আলী (রা.) শাহাদত বরণ করেছেন; তাদের শোকে তো কোনো মাতম করার প্রমাণ ইসলামে পাওয়া যায় না। কারণ, ইসলামে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে নিঃসন্দেহে আমরা বলতে পারি, হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) খিলাফতে রাশেদার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নিজ দেহের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দান করে গেছেন। যুগ যুগ ধরে তার এই ত্যাগ মুসলিম উম্মাহকে খিলাফতে রাশেদার অনুরূপ আল্লাহ মনোনীত খলিফা ও ঐশী ইমামতের ছত্রছায়ায় জীবন অতিবাহিত করার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনার জন্য প্রত্যেক মুসলমানই সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করে থাকে আর শিয়ারা প্রতিবছর মহররম মাসে নিজস্ব রীতি অনুসারে সেই দুঃখ এবং বেদনায় হাহুতাশ করে থাকে। যদিও আমাদের দৃষ্টিতে তারা এ ক্ষেত্রে খুবই বাড়াবাড়ি করে। কারবালায় হজরত ইমাম হোসাইন (রা.), তার পরিবারের সদস্যদের এবং কয়েকজন সাথি-সঙ্গীকে বড় নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এ ঘটনা হজরত ওসমান (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনারই একটি ধারাবাহিকতা।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) যে শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন তা কীভাবে পদদলিত হয়েছে হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনার মাধ্যমে তা ফুটে উঠেছে। হজরত হোসাইন (রা.)-এর সৈন্য বাহিনীর ওপর যখন শত্রু নিয়ন্ত্রণ পায় তখন তিনি ঘোড়া সমুদ্রমুখী করে অগ্রসর হওয়ার জন্য ইচ্ছা করেন তারপরও তাকে বাধা দেওয়া হয় এবং তার প্রতি তির ছোড়া এবং সেই তির হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর চিবুকের নিচে লাগে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি শাহাদাতের পূর্বে তাকে এ কথাই বলতে শুনেছি, আল্লাহর কসম, আমার পর খোদার এমন কোনো বান্দাকে তোমরা হত্যা করবে না, যার হত্যার কারণে আল্লাহ তোমাদের প্রতি আরো বেশি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন। আমি আশা করি, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন আর আমাকে সম্মানিত করবেন। এরপর আমার হত্যার প্রতিশোধ এমনভাবে নেবেন যে, যা তোমরা ভাবতেও পার না। খোদার কসম, আমাকে যদি তোমরা হত্যা কর তাহলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের মাঝে যুদ্ধ সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের রক্ত ঝরবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বেদনাদায়ক শাস্তিকে আল্লাহ বহুগুণে বৃদ্ধি না করেন তিনি বিরত হবেন না। তাকে শহীদ করার পর কুফাবাসী তার পবিত্র লাশের সঙ্গে কী ব্যবহার করেছে দেখুন, আমর বিন সাদ আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা দেয়, কে কে হজরত ইমাম হোসেনের মৃত দেহের ওপর ঘোড়া দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত। এ কথা শুনে ১০ জন ঘোড়সওয়ার বের হয়, যারা নিজেদের ঘোড়া নিয়ে তার পবিত্র দেহের ওপর ঘোড়া দৌড়ায় এবং পিষ্ট করে আর তার বক্ষ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই যুদ্ধে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দেহ ৩৫টি তির বিদ্ধ হয়। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মরদেহ পরবর্তীতে কুফার গভর্নরের কাছে পাঠানো হয়, সে তার শিরোñেদ করে এজিদের কাছে প্রেরণ করে।
ধর্মের সঙ্গে তাদের দূরতম সম্পর্ক নেই। এদের উদ্দেশ্য হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) উপলব্ধি করতে পেরেছেন, যার ফলে তিনি এজিদের বয়াত করতে অস্বীকার করেছেন। তিনি এজিদের প্রতিনিধিদের এ কথাও বলেছিলেন যে, আমি যুদ্ধ চাই না, আমাকে যেতে দাও, আমি গিয়ে খোদার ইবাদত করতে চাই বা কোনো সীমান্তে আমাকে পাঠিয়ে দাও যেন ইসলামের জন্য যুদ্ধ করতে করতে আমি শাহাদত বরণ করতে পারি বা আমাকে এজিদের কাছে নিয়ে যাও, যাতে আমি তাকে বোঝাতে পারি যে, আসল ব্যাপার কী। কিন্তু তার প্রতিনিধিরা কোনো কথা শোনেনি। অবশেষে যুদ্ধ যখন চাপানো হয় তখন বীরপুরুষের মতো মোকাবিলা করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। এই স্বল্পসংখ্যক মুসলমান যাদের সংখ্যা ৭০-৭২ হবে, তাদের মোকাবিলায় ছিল এক বিশাল সৈন্যবাহিনী। এদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। একে একে তারা সবাই শাহাদত বরণ করেন। আল্লাহ তায়ালার প্রতিশোধ নেওয়ার নিজস্ব রীতি আছে যেভাবে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজেই বলেছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা আমার হত্যার প্রতিশোধ নিবেন আর আল্লাহ তায়ালা প্রতিশোধ নিয়েছেনও। এজিদ বাহ্যত সাময়িক সফলতা লাভ করেছে। প্রশ্ন হলো এজিদের নেকির কারণে কী আজকে কেউ তাকে স্মরণ করে? যদি তার সুখ্যাতি থাকত তাহলে মুসলমান নিজেদের নাম এজিদই রাখত কিন্তু কোনো ব্যক্তি নিজের বাচ্চার নাম আজ এজিদ আর রাখে না। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর জীবনের একটি উদ্দেশ্য ছিলÑ তিনি কখনো রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জনের লোভ রাখতেন না, তিনি সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিনি ন্যায়ের জন্য দ-ায়মান হয়েছিলেন। হজরত ইমাম হোসাইনের ত্যাগ, কোরবানি আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রেখে গেছে। নিজের অধিকার নিজের জীবন বাজি রেখে পৃথিবীতে সত্যের প্রসার করেছেন, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি সত্য প্রচারের যে আদর্শ রেখে গেছেন তা সব সময় আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। আর এর ওপর যদি আমরা প্রতিষ্ঠিত থাকি তাহলে সেই বিজয়ের অংশ হবে যা ইসলামের জন্য অবধারিত। কারবালা প্রান্তরে তার শাহাদত বরণ ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। সত্য, ন্যায় এবং নবুয়াতের পদ্ধতিতে আল্লাহর জমিনে সত্যিকারের ইসলামি খেলাফত পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গী-সাথিরা যে ত্যাগ ও কোরবানি স্বীকার করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত তা আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সত্যের পথে এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের তা জোগাবে হিম্মত ও প্রেরণা।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক
"