মাহমুদুল হক আনসারী

  ০২ আগস্ট, ২০১৮

পর্যবেক্ষণ

আসামে বাঙালি খেদাও অভিযান

আসামে বাঙালিদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে। রাজ্যজুড়ে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে গত সোমবার সকালে ভারতের আসামে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) চূড়ান্ত খসড়ার তালিকা প্রকাশ হয়েছে। আগে থেকেই আশঙ্কা ছিল এ তালিকায় বাদ যাবেন অনেক বাংলা ভাষাভাষীর জনগণ। চূড়ান্ত খসড়া তালিকার জন্য তিন কোটি ত্রিশ লাখ মানুষ আবেদন করলেও ঠাঁই পেয়েছেন মাত্র দুই কোটি নব্বই লাখ। বাদ গেছে চল্লিশ লাখের বেশি মানুষ। গত সোমবার সকাল ১০টায় তালিকা প্রকাশের পর দাবি বা অভিযোগ জানানোর জন্য এক মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ সময় আবেদনকারীদের দাবি, যাচাই-বাছাই করে এ বছরের মধ্যে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশ করা হবে। নতুন তালিকা তৈরি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এ প্রক্রিয়াকে ‘বাঙালি খেদাও’ অভিযান নামে আখ্যা দিয়েছেন। টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিবিসি, আনন্দবাজার পত্রিকাসহ আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে এ খবর তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশত প্রথম খসড়া তালিকায় স্থান হয়েছিল মাত্র এক কোটি নব্বই লাখ মানুষের। এনআরসির দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশের পর আসামে কয়েক যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে বসবাস করে আসা বহু বাংলা ভাষী মুসলিম ও হিন্দুদের নাগরিকত্বহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা এখন জোরালো হলো। তালিকায় নাম না থাকা অনেকেই মনে করছেন, এখন থেকে যেকোনো সময় অবৈধ নাগরিক হিসেবে আসাম তথা ভারত থেকে বের করে দেবে। সাম্প্রতিক আসাম থেকে অবৈধ বাংলাদেশিকে ধরে ধরে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হচ্ছে। যেসব প্রকৃত ভারতীয়র নাম খসড়া তালিকায় উঠে আসেনি, তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হওয়ার ও পরামর্শ দিয়েছেন ভারতের এনআরসি রেজিস্ট্রার জেনারেল শৈলাষ। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের অবশ্যই সহযোগিতা ও সময় দেওয়া হবে। আসামের নাগরিক তালিকা প্রকাশ ও বহুসংখ্যক মানুষের নাম না থাকাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এটাকে ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিভাজনের উসকানি দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বাদপড়া চল্লিশ লাখ বাংলা ভাষাভাষীর ভবিষ্যৎ কী হবে? বিপুলসংখ্যক এ মানুষের পুনর্বাসন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কি দায়িত্ব আছে? মানুষগুলো এখন নিজ দেশেই উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে। তাদের যদি বাংলাদেশে পুশব্যাক করার সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশ সরকার যদি তাদের ফেরত নিতে রাজি না হয়, তাহলে তাদের কী পরিণতি হবেÑএসব বিষয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাদপড়া মানুষগুলো যেকোনো সময় তাদের দীর্ঘদিনের নাগরিক অধিকারের জন্য সহিংস আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এ আশঙ্কায় আসাম জুড়ে ইতোমধ্যে হাই-অ্যালার্ট জারি করেছে প্রশাসন। পুলিশকে চূড়ান্ত শতর্কতা দেওয়া হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সে দেশের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আসাম ও প্রতিবেশী রাজ্যগুলোয়ও এরই মধ্যে ২২ হাজারের অধিক আধাসেনা মোতায়েন রাখা হয়েছে। সব সরকারি-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রকাশিত খসড়া তালিকা থেকে দেখা যায়, তিন কোটি ঊনত্রিশ লাখ একানব্বই হাজার তিন শ চুরাশিজন নাগরিক তালিকায় যুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে দুই কোটি ঊনানব্বই লাখ তিরাশি হাজার ছয় শ সাতাত্তরজনের নাম তালিকায় স্থান পেয়েছে। বাদ পড়েছে চল্লিশ লাখ সাত হাজার সাত শ সাতজন। অনলাইনে এসএমএসের মাধ্যমে হেলফলাইনে ফোন করে বা সেবাকেন্দ্র থেকে যারা বাদ পড়ছেন তা জানা যাবে। সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, আজ শুধু আসাম নয়, দেশের জন্য ঐতিহাসিক এক দিন। তিনি দাবি করেন, এত বিরাট জটিল প্রক্রিয়া শুধু আসাম নয় এ পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও হয়নি। ১৯৫৫ ও ২০০৩ নাগরিকত্ব আইন ও নির্দেশিকা মেনে পরিচ্ছন্নভাবে প্রক্রিয়া চলছে। সাড়ে ছয় কোটি নথিপত্রের অনেক তদন্ত ও যাচাই প্রক্রিয়া চলেছে। ২০১৩ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এটা খসড়া মাত্র। তার বক্তব্যে বাদপড়া নিজেদের নাম যুক্ত করা বা সংশোধনের পর্যাপ্ত সুযোগ পাবেন। যারা পাবেন না, তাদের সাহায্য করবে দফতর। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার পাবেন সব ভারতীয় নাগরিক। একই মন্তব্য করে সে দেশের স্বরাষ্ট্র দফতরের যুগ্মসচিব সত্যন্দ্র গর্গ বলেন, এ খসড়ার ভিত্তিতে সীমান্ত শাখা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কেউ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। কাউকে রিটেনশন শিবিরে নিয়ে যাওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কেন্দ্র সব ধরনের সাহায্য করবে। কেউ উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। ১৯৫১ সালের পর এ প্রথমবার আসামে নাগরিক তালিকা হালনাগাদ করা হলো। উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ রাজ্যে অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করা। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে যারা বাংলাদেশ থেকে আসামে গিয়েছিলেন, তাদের নাম নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তালিকায় নাম না থাকা মানুষের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে তীব্র আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তালিকায় নাম না থাকা মানুষগুলো রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে খোলা কন্ট্রোল রুমে ভিড় শুরু করেছে। সে দেশের স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরী বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটি বংলা ভাষাভাষীর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। আসামে থাকতে হলে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভুত্ব মেনেই থাকার প্রক্রিয়া চলছে। ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম সে দেশের কর্তৃপক্ষকে উদ্ধৃত করে বলছে, অবৈধ বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে ৫২ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এভাবে যারাই অবৈধভাবে বসবাসকারী মানুষ বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত হবে, তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলবে বলে জানা যায়। যদি এভাবে ৪০ লাখ মানুষ বাংলাদেশে পুশব্যাক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাহলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশের কী অবস্থা দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে এখন থেকে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও পরামর্শে বসতে হবে। ভারত প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে সব সময় বাংলাদেশের মানুষের সুখে-দুঃখে ছিল। এখনো তাদের সে মনোভাব আছে বলে আমাদের বিশ্বাস। বাংলাদেশের জনগণ ও রাষ্ট্রের দুঃখ-দুর্দশা বাড়বেÑএমন ধরনের কার্যক্রম থেকে ভারত সরকার বিরত থাকবে বলে এ দেশের জনগণের বিশ্বাস। স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির আলোকে

ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আসাম সংকট যেন সমাধান খুঁজে পায়, সেটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা। অন্যথায়, ৪০ লাখের অধিক আসামের নাগরিক বাঙালি হয়ে দেশে ফেরত এলে আরেকটি রোহিঙ্গা সংকটের জন্ম নেবে বলে আশঙ্কা করছে সচেতন মানুষ। আসাম সংকট বাংলাদেশে সৃষ্টি না হতেই ভারতের সঙ্গে সরকারের বন্ধুসুলভ দ্বিপক্ষীয় আলোচনা প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক ও প্র্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist