এস এম মুকুল

  ০২ জুন, ২০১৮

নিবন্ধ

আশার আলোয়

‘শিশু পরিষদ’ একটি শিশু সংগঠনের নাম। ৮ থেকে ১৬ বছরের সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের নিয়ে গঠিত হয়ে ব্যতিক্রম এই শিশু ফোরামটি। নোয়াখালী পৌরসভার মহোদুরি কলোনি, ভুলুয়া কলোনি, ওহাব কলোনি, সোনাপুর খালপাড় এবং মহব্বতপুর এলাকার ২৪০ জন শিশু-কিশোর নিয়ে কাজ করছে ফোরামটি। এসব শিশুর মধ্যে ২০টি দল তৈরি করা হয়েছে। এই ২০টি দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয়েছে ৪টি আঞ্চলিক শিশু পরিষদ। আবার এই ৪টি আঞ্চলিক পরিষদের ১৬ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে জেলা শিশু পরিষদ। এভাবেই সংগঠিত হয়ে শিশুরা নিজেদের পরিবার, সমাজ ও কর্মস্থল শিশুর উপযোগী, নিরাপদ ও সহায়ক করে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। ওরা এখন নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধান করছে। কখনো বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করে সমাধানের পথ খুঁজে নিচ্ছে তারা। এই অভিনব সংগঠনের প্রতিটি শিশুই সুবিধাবঞ্চিত। অভাবের দায়ে তাদের কেউ বাদাম বিক্রি করে, কেউ কাজ করে চায়ের দোকানে, কেউ মুদি দোকানে, কেউ-বা কাজ করে মোটর ওয়ার্কশপে। কর্মজীবী এই সংগঠিত শিশুরা কাজের অবসরে আলোচনা সভা, মতবিনিময় এবং উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ ও শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। তারা এসব বিষয়ে বড়দের সঙ্গেও আলোচনা সভা, অ্যাডভোকেসি সভা, সমাবেশ, র‌্যালি, মানববন্ধন ও গণনাটকের আয়োজনের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টিতে সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছে। শিশু সংগঠনের প্রতিনিধিরা কলোনিতে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি শিশুদের প্রতি বড়দের নির্যাতন, বাল্যবিবাহ এবং অমানবিক আচরণ না করার জন্য সবাইকে সজাগ করে দিচ্ছে। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে শিশু শ্রমিকদের কর্মস্থলের পরিবেশ, নিরাপত্তা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ না করানো, কর্মঘণ্টা এবং স্বাস্থ্য ও বিনোদনমূলক পরিবেশে কাজ করার দাবি ও অনুরোধ জানাচ্ছে। তাদের এখন বিশাল কর্মযজ্ঞ। কলোনিতে পাঠশালা স্থাপন করে কর্মজীবী শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে। সপ্তাহে এক দিন এই শিশুরা মিলে কলোনির নিরক্ষর বয়স্কদের স্বাক্ষরজ্ঞান করার উদ্যোগ নিয়েছে। শিশুদের এই অভিনব কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করার জন্য তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় পৌরসভার চেয়ারম্যান সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। তিনি ১২০ জন কর্মজীবী শিশুর পড়াশোনা চালিয়ে রাখার জন্য দুই মাস অন্তর অন্তর শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সহায়তা দায়িত্ব নিয়েছেন। চেয়ারম্যান শিশুদের পাঠশালার জন্য স্থায়ী ঘর নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছেন। শিশুপরিষদ এখন সমাজের অভিভাবক শ্রেণি কেউ শিশুদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করে তুলেছে। বাল্যবিবাহ ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে শিশুদের জন্য ফ্রি-চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেছে। জেলা শিশু একাডেমিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, অভিনয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ইউনিসেফ বাংলাদেশের সহযোগিতায় জেলায় কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিমোল্ড ও বন্ধন যৌথভাবে ২০০৪ সালের জুন মাস থেকে শিশুদের সংগঠিত করে শিশু অধিকার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করে তুলছে। এই অভিনব উদ্যোগকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে নিশ্চিত ও নিরাপদ হতো আমাদের শিশুদের অনাগত ভবিষ্যৎ।

শোক কীভাবে শক্তিতে পরিণত হয় এই গল্পটি তারই প্রমাণ দেবে। ১৯৯৫ সাল, ১৭ জুন একটি দুর্ঘনার শোক অবশেষে মানবকল্যাণের শক্তিতে রূপান্তরিত হলো। হ্যাঁ, সেদিনের এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য মুহম্মদ আসলাম মৃত্যুবরণ করেন। আসলামকে হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা শোকে কাতর হয়েও ইতিবাচক ও মানবকল্যাণমূলক কিছু করে তার স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়। পারিবারিকভাবে আসলামের পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তার নামে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তোলার। আসলাম বেঁচে থাকলে সে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পেত, সুতরাং তার প্রাপ্য অংশীদারিত্বের অর্থ দিয়ে চালু হবে এই মানবকল্যাণমুখী ফাউন্ডেশনটি। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় পারিবারিক জাকাত তহবিলের যাত্রাও। সৃজনশীল কল্যাণধর্মী চেতনা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আসলাম স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনের নেপথ্য নায়ক আসলামের বড় ভাই ডা. এস এম এম হাসান। ভাইয়ের স্মৃতি রক্ষায় পরিবারেরর সব সদস্যকে নিয়ে মানবকল্যাণের নজিরবিহীন অনন্য দৃষ্টান্ত দাঁড় করালেন তিনি। এখন এই ফাউন্ডেশনের বিশাল কর্মযজ্ঞে মানবসেবার অনন্য প্রতিষ্ঠান ‘আসলাম স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশন ৮-৯ বছরের ৩০ জন শিশুকে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা ও শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে শুরু হয় তাদের মানবকল্যাণের জয়যাত্রা। এই শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, ছাত্রাবাস, পুষ্টিসম্মত পচ্ছিন্ন খাবার এবং আবাসিক শিক্ষকের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। আছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও। এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর যষ্ঠ শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত ১৫০ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ করে এই ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৪ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে মেধা মূল্যায়নের ভিত্তিতে ৩৫ জনকে দেওয়া হয় শিক্ষা বৃত্তি। আসলাম ফাউন্ডেশন যেহেতু মানবকল্যাণে নিয়োজিত, তাই তাদের ভাবনায় আসে হতদরিদ্র শিশুদের পাশাপাশি তাদের পারিবারিক দারিদ্র্যদূরীকরণে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০০২ সাল থেকে সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪০০ জন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ভাগ্য বদলের সংগ্রামে নেমেছেন। এই ঋণ নিয়ে গরিব মানুষেরা হাঁস-মুরগি, পশু পালন, গরু মোটাতাজাকরণ এবং সেলাই কাজের মাধ্যমে সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। আর্থিক অনটন কাটিয়ে ওঠার সুবাদে তারা সহজেই সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারছেন। আসলাম ফাউন্ডেশন এখন সমবায়ী ধারায় সদস্যদের সঞ্চয়মুখী করে গরিব মানুষদের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করছে। এই সঞ্চয়ের অর্থ থেকে অর্ধেক আর বাকি অর্ধেক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় সদস্যদের কিনে দেওয়া হচ্ছে গাভী, রিকশা ও ভ্যানগাড়ি। এ ছাড়া এলাকার বিদেশ গমনে ইচ্ছুক প্রার্র্থীদের দেওয়া হচ্ছে সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা। এই প্রকল্পের আওতায় ৪০ জন বিদেশগামীকে দেওয়া হয়েছে বিমান টিকিটের টাকা। প্রার্থীরা বিদেশ থেকে টাকা উপার্জন করে আয় থেকে দায় শোধ করবেন। এভাবেই দারিদ্র্যবিমোচনে আসলাম ফাউন্ডেশন গরিব মানুষদের কাছে পরম নির্ভরতার অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে।

আসলাম ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্যসেবাতেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আসলামের বড় ভাই ডা. এস এম এম হাসান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গ্রামের দরিদ্র ও সামর্থ্যহীন মানুষের চিকিৎসার্থে নিজেই চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। গরিব অসহায়দের তিনি বিনামূল্যে ওষুধপত্রও দিয়ে যাচ্ছেন। বছরে অন্তত ২৫ জনের চোখের অস্ত্রোপাচারের ব্যবস্থাও করেন তিনি। রক্তদান, রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, প্রতি বছর গ্রামের শতাধিক ছেলের খতনা ও মেয়েদের কান ফোঁড়ানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। ডা. হাসানের নেতৃত্বে তার এলাকায় মাঝেমধ্যে বসানো হয় মেডিকেল ক্যাম্প। এ ছাড়া বছরে আসলাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০টি পরিবারকে দেওয়া হয় মশারি এবং আরো ২০টি পরিবারকে দেওয়া হয় শীতবস্ত্র। এভাবেই স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ এবং আর্তকে সাহায্যের মাধ্যমে দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে আসলাম ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম। ভাইয়ের স্মৃতি রক্ষায় মানবকল্যাণের এই অনন্য উদ্যোগ মানবিক মূল্যবোধের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকুক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist