ইয়াসমীন রীমা

  ২৩ মে, ২০১৮

বিশ্লেষণ

পাচারকৃত ফিরতি নারী

অষ্টাদশী মেয়েটির হালকা-পাতলা গড়ন। ২০১২ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাচার হয়ে যায়। কয়েকটি এনজিওর সহায়তায় দেশে ফিরে এলেও ছয় বছর ধরে মেয়েটি রয়েছে বিএনডব্লিউএলের সেফ হোমে। পরিবার তাকে গ্রহণ করবে কি না, কী করবে, সেটা তার অজানা। মেয়েটি জানায়, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অভিমান করে ঘরছাড়া হয়েছিল সে। তারপর শাহীন নামের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। শাহীন তাকে কাজ দেওয়ার নাম করে ভারতে পাচার করে দেয়। ভারতের হায়দরাবাদের পুলিশ মেয়েটিকে গ্রেফতার করে একটি বেসরকারি সংস্থার হেফাজতে এনে দেয়। তাদের বিএনডব্লিউএলএ যোগাযোগ করে মেয়েটিসহ নয়জনকে ফিরিয়ে আনে। ভারতের এনজিও স্টপের কর্মকর্তা স্বপ্না মিশ্র বলেন, পাচারের শিকার ছয় নারী বাংলাদেশে এলেও দুজন ফিরে আসতে চায়নি। ভারতেই থেকে যেতে চেয়েছে।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়া গ্রামের ১৪ বছরের কিশোরী ময়নাকে ভারতের এক স্টিল কারখানায় চাকরির প্রলোভনে প্রলুব্ধ করে তার প্রতিবেশীরা পাচারকারীর কাছে বিক্রি করে দেয়। ভারতে পৌঁছে অনাথ ময়নার আশ্রয় হয় পতিতালয়ে। সেখান থেকে তাকে মুম্বাইয়ের এক দম্পতির কাছে ২০ হাজার রুপিতে বিক্রি করা হয়। দম্পতিটি তাকে যৌনকর্মেই নিয়োজিত রাখে। দৈনিক দশ-বারোজনের মনোরঞ্জন করতে হতো। মুম্বাইয়ে থাকাকালীন এক বাংলাদেশি যুবকের সহায়তায় ময়না পালিয়ে আসতে সমর্থ হয়। কুষ্টিয়া জেলার ১৭ বছরের তাসলিমা খাতুনকে তার ভগ্নিপতি সিনেমা দেখানোর কথা বলে ভারতে বিক্রির উদ্দেশ্যে সীমান্তবর্তী গ্রামে নিয়ে গেলে পাচারকারী ভগ্নিপতিকে জনগণ ধরে পুলিশে সোর্পদ করে এবং সে স্বীকার করে তার অপকর্মের কথা। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ময়না, তাসলিমা ও ফরিদার মতো শত শত নারী-শিশু পাচারের শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ২৮৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। সীমান্ত এলাকার ১১টি রুট দিয়ে নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে। উত্তরের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্ত পথ দিয়ে নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সীমান্ত মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ শহর। প্রথমে পাচার করা নারী ও শিশুদের এ শহরে রাখা হয়। পরে পাচারকারীদের সুবিধামতো তাদের অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। যশোর থেকে পাচারকারীরা ভোমরা, কলারোয়া, দর্শনা জীবননগর ও ঝাউডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশু পাচার করে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্তবর্তী ফরিদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, নড়াইল, কুষ্টিয়া, যশোরের ঝিকরগাছা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, পার্বত্যাঞ্চলের কক্সবাজার ইত্যাদি জেলাগুলো পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নদী ও স্থলসীমান্ত মিলিয়ে প্রায় ২০০ কিমি সীমান্ত এলাকায় রয়েছে অসংখ্য চোরাচালানি ঘাটমালিক। নারী ও শিশু পাচার বাবদ ঘাটমালিকরা জনপ্রতি তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা নিয়ে থাকে। এ টাকার ভাগ চলে যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছেও। যে কারণে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা সব সময়ই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সীমান্তে ঘাটমালিকদের আওতায় মাঠপর্যায়ে কর্মরত রয়েছে শত শত পুরুষ ও মহিলা মাঠকর্মী, যারা সার্বিক অবস্থা দেখাশোনা করে। ঘাটমালিকদের কাজ হচ্ছে শুধু সীমান্ত পার করে ভারতীয় এজেন্টদের হাতে তুলে দেওয়া। মাঠপর্যায়ে যেসব কর্মী রয়েছে, তারা দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভারতে ভালো চাকরি ও একাধিক বিয়ে করে বউ সাজিয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসে মানুষ পাচারের নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটে। সিন্ডিকেটের রয়েছে নির্দিষ্ট লাইনম্যান এবং লাইনম্যানের কাজ হলো সবুজসংকেত দেওয়া। সবুজসংকেত মিললেই ঘাটমালিক একটি বিশেষ বাহিনীকে নগদ টাকা-পয়সা লেনদেনের মাধ্যমে রাতে অথবা ভোরে তাদের পাচার করে। লাইনম্যানরা সাধারণত বিডিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও টহলরত বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) গতিবিধির আগাম সংবাদ পৌঁছে দেয় সিন্ডিকেটের কাছে। মোটা অঙ্কের চুক্তির বিনিময়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করে থাকেন। পাচার হয়ে যাওয়া উদ্ধারকৃত ১৪ বছরের রোকসানা বলে, ‘সীমান্তপথে পাচারের সময় অধিকাংশ নারী শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে দালালদের হাতে। সীমান্তের যেসব নির্জন বাড়িতে রাখা হয়, সেখানে দালালরাই জোর করে তাদের ধর্ষণ করে। অন্যদিকে ভারতীয় সীমান্তে রয়েছে আরো ভয়ংকর ফাঁদ। সীমান্তরক্ষী বাহিনী পছন্দমতো নারীকে বেছে নিয়ে ধর্ষণ করে দালালকে পাচার কাজে সহযোগিতা করে।

মানব পাচার-সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাফিকিং ইন পার্সনস (টিআইপি) রিপোর্ট ২০১৭ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৮৮টি দেশের মানব পাচার-সংক্রান্ত তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তিন স্তরের তালিকার দ্বিতীয় স্তরেই আছে বাংলাদেশ। এখনো পুুরুষ, নারী শিশু পাচারের উৎস দেশ হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশে। মানব পাচারের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকা- নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারে প্রতি বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন (এইচটিডিএসএ) কার্যকরে আরো জোরালো ভূমিকা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর এই আইন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে সরকারি সংস্থা বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন, শ্রমিক পরিদর্শক ও অভিবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন লাখের বেশি নারী-শিশু পাচার হয়েছে ভারতে। তবে বেসরকারি বিভিন্ন এনজিওর দাবি, পাচারের সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি। এর আগে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে থাকে। অন্যদিকে ভারতীয় সমাজকল্যাণ বোর্ডের এক তথ্যে বলা হয়, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী ও শিশু অবৈধপথে ভারতে পাচার হচ্ছে। পাচারের শিকার বেশির ভাগ নারীর স্থান হয় ভারতের যৌনপল্লীতে। পাচার ঘটনায় গ্রেফতারের স্থান পর্যালোচনা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, দেশের ২৮টি জেলাসংলগ্ন সীমান্ত পথগুলোকেই পাচারের প্রধান রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিদেশে জনশক্তি প্রেরণকারী কিছু প্রতিষ্ঠান ও তাদের সহযোগী হোটেল ও বারের মালিক, পতিতালয় ও বস্তি পরিচালনাকারী আগে পাচার হওয়া ব্যক্তি এবং আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যরা দেশে পাচারের কাজে সক্রিয় রয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘বিগত আড়াই বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ২ হাজার ৬৫৫টি শিশু নিখোঁজ হয়েছে। এর মধ্যে ২ শতাংশ অর্থাৎ ৩৫টি শিশুকে পুলিশ, বিডিআর এবং স্থানীয় লোকজন উদ্ধারে সক্ষম হয়েছেন। একই সময়ে ১ হাজার ২১৯টি শিশু অপহৃত এবং ১ হাজার ৭টি শিশু পাচার হয়েছে। এসব শিশুর বয়স ১০ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। এ গবেষণা দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে করা হয়েছে। বাস্তবে এ সংখ্যা আরো ভয়াবহ, কারণ পাচারের সব খবর পত্রিকায় আসে না। গত বছর ৬৭৭টি পাচারের ঘটনার মধ্যে মামলা হয়েছে মাত্র ৮৩টি।

মানব পাচার বন্ধে দেশে বেশ কিছু আইন রয়েছে। ২০১১ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন সরকার অনুমোদন করে। এ আইনের অধীনে মানব পাচার এ সর্বোচ্চ শাস্তির মৃত্যুদ-ের বিধান রয়েছে। নারী ও শিশু পাচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারিত হয় মৃত্যুদ-। অন্যান্য ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ-। জরিমানা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা কিংবা উভয় দ-। নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ অনুসারে, পাচারের অপরাধ বিচার করার জন্য প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে বিশেষ আদালত গঠিত হয়েছে। মামলা দায়েরের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে পাচারের অপরাধে তদন্ত এবং ১২০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করতে হবে। তদন্তকালে আসামি জামিন পাবে না। আসামির অনুপস্থিতিতেও বিচারকাজ সম্পন্ন হবে এবং শিগগিরই সম্ভব বিচারকাজ শেষ করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট যেকোনো স্থানে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাক্ষীর অভাবে আসামিরা রক্ষা পেয়ে যায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আয়েশা খানম বলেন, ইমিগ্রেশন বিভাগের এক শ্রেণির কর্মকর্তা, স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকজন, পাসপোর্ট অফিসের এক শ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশে পাচারকারী আকাশপথে দিব্যি নারী ও শিশু পাচার করে যাচ্ছে। বাংলাদেশি নারী ও শিশু এইচআইভি-এইডস সংক্রমিত না হওয়ায় ভারত পাকিস্তান ও নেপালের বাজারে বেশ চাহিদা রয়েছে।

সরকারি হিসাব মতে, ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত ছয় বছরে ২ হাজার ৩১১ জন নারী ও শিশুকে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৩৩০ জন নারী ও ৯৮১ জন শিশু। এর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৯৯৯ জন নারী ও শিশুকে। পাচারের এসব ঘটনায় ১ হাজার ৯১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতি মাসে অন্তত ৪২০ জন নারী ও শিশু পাচারের শিকার হয়।

লেখক : গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist