বিশ্বজিত রায়

  ১৮ এপ্রিল, ২০১৮

দুর্ঘটনা

সড়কে মৃত্যুর মহাযজ্ঞ

সড়কে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ মৃত্যুদানব মানুষকে পিষে মারার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অনভিপ্রেত এ অঘটনের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়তই কারো বাবা, কারো মা, কারো ভাই, কারো বোনের বেপরোয়া গতির রোষানলে পড়ে প্রাণ বিসর্জনের অকালপ্রয়াত গল্পে আটকে যাচ্ছেন। আর স্বজনহারা পরিবার-পরিজন দুঃখের আজীবন বোঝা বয়ে বেড়ানোর বীভৎস গ-িতে হাবুডুবু খাচ্ছেন। সম্প্রতি কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার মতো অমানবিক অঘটন পত্রিকান্তরে ঝড় তুলেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া আদৌ কি সম্ভব। এই অনাকাক্সিক্ষত অঘটনে অকালে চলে যাওয়া কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করে জীবনের রঙিন খেলায় পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো শুধু নীরবে কেঁদেই চলেছেন।

অঙ্গহীন অভিমানে পুড়ছেন তিনি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে নিজেকে নিভৃত রাখার চেষ্টা করছেন। কেউ খাওয়াতে চাইলে রাগে, ক্ষোভে কথা বলছেন। অভিমানী স্বরে প্রশ্ন ছুড়ছেন, খেয়ে কী হবে, বেঁচে থেকেই বা কী লাভ? হাতহারা দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতর মানুষটি দানাপানি ছেড়ে ভেতরের প্রলয়ঙ্করী জীবন অতীষ্ঠ বোধশক্তির গতিসম্পন্ন রেশ উন্মুক্ত করতে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যর্থ প্রচেষ্টা। শহরে পড়ালেখা করতে আসা ছাত্রত্বের মেধা যাচাই, মেধাবী অস্তিত্ব ও অস্তিত্বে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারের সচ্ছলতা টিকিয়ে রাখতে একটি কর্মপন্থা বেছে নিয়ে যখন আত্মসমৃদ্ধির পথ খুঁজছিলেন, ঠিক তখনই আচমকা ধেয়ে এলো সড়কের দানব। একটি সুস্থ ও সুন্দর স্বপ্নমাখা শরীরে বসিয়ে দিল মরণকামড়। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল ডান হাত। বলছিলাম ৩ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় হাত হারানো তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের কথা। রাজধানীর সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারান মুমূর্ষু রাজীব। বাসের চাপায় তার ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই বিচ্ছিন্ন জীবনে তিনি বেঁচে থাকার সাধ তখনই হারিয়ে ফেলেছেন। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। একটি সড়ক দুর্ঘটনা থামিয়ে দিয়েছে তার জীবনকে।

মাতৃদেহ স্বচক্ষে পিষ্ট হতে দেখেছে ছেলে। দৌড়ে এগিয়ে ঘাতক বাস প্রাণপণে ঠেলে মাকে বাঁচানোর অসহায় প্রচেষ্টা শুধু কান্নাই উপহার দিয়ে গেল। বিনিময়ে বেপরোয়া বাস কেড়ে নিল জন্মদাত্রী জননীর জীবন। চাচার মৃত্যুর সংবাদ শুনে টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগের বাসায় ছুটে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া তুহিন। ৫ এপ্রিল সেখান থেকে মাকে নিয়ে যাচ্ছিল গ্রামের বাড়ি আবদুল্লাহপুরে। কিন্তু গ্রাহ্যহীন চালকের নিষ্ঠুরতায় এক শোকের সঙ্গে যুক্ত হলো আরেক শোকার্ত ক্ষত। দুর্ঘটনার এমন পৈশাচিক তৎপরতা ছেলে তুহিনকে শোকসাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেল মাতৃহীন যন্ত্রণা। অন্যদিকে মায়ের কাছে বিস্কুটের বায়না ধরা শিশুকন্যার চাওয়া পূরণ করতে পারেননি এক হতভাগা মা। রাস্তার ওপাশের দোকানে যেতে কন্যাশিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে কেড়ে নিল প্রাণপ্রিয় সন্তানের জীবন। ৪ এপ্রিল খুলনা নগরীর খালিশপুরে আলমনগর পোড়া মসজিদের সামনের সড়কে একটি বিআরটিসি বাস ধাক্কা দিলে মা শিমুল আক্তার ও মেয়ে তামিমা আক্তার তন্বী ছিটকে পড়েন রাস্তায়। এতে মা শিমুল মারাত্মক আহত হলেও ঘটনাস্থলেই মারা যায় ছোট্ট তন্বী। এ যেন প্রতিদিনকার সংবাদ। সড়কে এমন দুর্ঘটনা নিত্য নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনার অসহনীয় সংবাদ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। যাত্রার নির্ভীক পথে যাত্রীবেশী প্রাণে জন্ম দিচ্ছে উৎকণ্ঠিত ভাব। দুর্ঘটনার ভয়াবহ সংবাদ সবাইকে অস্থিরতার দিকে ধাবিত করছে। দিন দিন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে, দেশে প্রতিদিন গড়ে দুর্ঘটনায় সড়ক-মহাসড়কে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ সালে আগের বছরের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ শতাংশ প্রাণহানি বেড়েছে। নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচার তথ্যানুসারে-২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৫ হাজার ৬৪৫ জনের। সংস্থাটির হিসাবে, ২০১৬ সালের চেয়ে দেড় হাজার মৃত্যু বেড়েছে ২০১৭ সালে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২ হাজার ৩৯৪ জনের। আর যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে এ সংখ্যা ৮ হাজার।

অনাকাক্সিক্ষত অঘটনের কবলে পড়ে অনেক জীবন চলে গেছে জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই। সঙ্গী হয়েছে নীরব কান্না। কিন্তু কেন এই জীবন্ত প্রাণবধের অহেতুক প্রতিযোগিতা? প্রশ্নটা যদি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে উত্তরটা কী হতে পারে। উত্তর যাই হোক, বাস্তবতা বলছে, একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে এবং সেখানে পতিত হচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। এর কারণ খুঁজতে গেলে সবার আগে বেরিয়ে আসবে চালকের অদক্ষতা এবং বেপরোয়া চালনা। অঘটনের কারণ জানতে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চালকই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আসামি। যে চালকের খামখেয়ালিপনায় অকালে নিভে যাচ্ছে অসংখ্য জীবনপ্রদীপ, সেই চালকের কী হচ্ছে? সংবাদমাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে সস্তা সংবাদের পথ্য জুগিয়ে যাচ্ছে তার কটি সংবাদ আছে, কোনো দুর্ঘটনার জন্য চালকের শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে রাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনায় পতিত যানের কারণ অনুসন্ধানের সঠিক তদন্ত রিপোর্ট প্রদর্শন কিংবা দোষী চালকের শাস্তি নিশ্চিতে আশা জাগানিয়া সংবাদ কারো চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না।

সড়ক-মহাসড়কগুলোয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। অনাকাক্সিক্ষত এ অঘটন রোধে রাষ্ট্রকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে দুর্ঘটনার আসল কারণ। এর জন্য শুধু চালক নয়; আরো অন্য কারণ থাকতে পারে। চালকের ওপর একতরফা দোষ চাপিয়ে বাকি ত্রুটিগুলো মাটিচাপা দিলে সেটা হবে অপ্রতিরোধ্য অঘটনে আরেকটু সুযোগ তৈরি করে দেওয়া বৈকি। তাই সব ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। যেমনÑসড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাতটি সাধারণ কারণ শনাক্ত করেছে জাতীয় কমিটি। সেগুলো হলো বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, নিয়মভঙ্গ করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা, চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের ঘাটতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও চলাচলের অনুপযোগী সড়ক।

ভাবতে হবে মানুষের জীবন নিয়ে। জীবন কোনো কচুপাতার পানি নয়, নাড়া দিলাম আর ঝরাত করে মাটিতে পড়ে গেল। ব্যস এখানেই জীবনের পরিসমাপ্তি। স্মরণে রাখা ভালো, একটা জীবন একটি পরিবারকে নেতৃত্ব দেয়। তার ভরণপোষণে চলে পরিজন, চলে সংসারসর্বস্ব। এমন পরিস্থিতিতে যদি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি অসময়ে অঘটনের বলি হয়, তাহলে কী হবে? রাষ্ট্র বা সমাজ কেউই কোনো সন্তোষজনক সমাধান দিতে পারবে না। যে চলে যায় সে আর আসে না ফিরে। সেটা হোক স্বাভাবিক মৃত্যু কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যু। মৃত্যু সবাইকে কাঁদায়। তবে সড়ক দুর্ঘটনার মতো অস্বাভাবিক মৃত্যু সবচেয়ে বেশি পীড়াদায়ক। সেই মৃত্যুতে যেমন দুঃখ থাকে, তেমনি থাকে সারাজীবনের ক্রন্দন ক্ষত। যে যাতনা জীবনের শেষভাগ পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়ায়।

যারা সড়ক দুর্ঘটনার মতো অঘটনের পাল্লায় পড়ে অকাল প্রয়াত হয়েছেন, তারা হয়তো বেঁচে গেছেন। আর যারা আহত হয়ে পঙ্গু অবস্থায় জীবন পার করছেন, তারা অনেকটা অর্ধমৃতরূপে টিকে আছেন এ জীবন-সংসারে। এই বাঁচা-মরার দুরন্ত গতি থামানোর শুভশক্তি এ দেশে আছে কি নাÑতা কারো জানা নেই। তবে এটা পরিষ্কার, বিশ্বের সব দেশে কমবেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মতো এমন অসম প্রতিযোগিতা অর্থাৎ নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনার নজির হয়তো কোথাও নেই। আর থাকবেই বা কেমনে! এখানকার মতো চালক আসনে অদক্ষ চালক কিংবা নিয়মনীতির ভ্রƒক্ষেপবিহীন বলদ মার্কা যানবাহন পরিচালনার পর্যাপ্ত ক্ষমতা কোথাও কি আছে? যত দিন পর্যন্ত যোগাযোগ ক্ষেত্রে বিশেষ করে সড়ক-মহাসড়কগুলোয় যান চলাচলের ওপর কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় না থাকবে, তত দিন পর্যন্ত এমন অঘটনের বলি হতে হবে সাধারণ মানুষকে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist