মো. মাঈন উদ্দিন

  ০৯ এপ্রিল, ২০১৮

বিশ্লেষণ

নৈতিকতার চূড়ান্ত অবক্ষয়

আমার দাদা একজন প্রবীণ মানুষ। যাকে আমরা আমাদের পরিবারের বাতি বলেই জানি ও মানি। তিনি এখনো পরিবারের সব দিক দেখাশোনা করছেন খুব বিচক্ষণতার দিকে। ফজরের নামাজ পড়ে আমার শোয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু দাদা ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হন। ভোরবেলা পত্রিকার হকার আমার রুমের দরজার নিচ দিয়ে পত্রিকা দিয়ে যান। সেই পত্রিকা পড়ার জন্য দাদা প্রায় প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণ শেষে আমার দরজায় টোকা দেয়। কিন্তু সেদিন ব্যতিক্রম হলো। দাদা আমার দরজায় টোকা দেননি, আমার ঘুম ভাঙাননি। আমি কিছুটা আশ্চর্য হলাম। পত্রিকা হাতে নিয়ে দরজা খোলে দেখি দাদা বারান্দার টেবিলে বসে আছেন। দেখেই বুঝতে পারলাম দাদার মন খারাপ। বললাম, ‘দাদা, আজ পত্রিকার জন্য ডাকলে না যে। তিনি বললেন, ‘পত্রিকা পড়ে কী হবে। পত্রিকার পাতা দেখলেই ভয় লাগে।’ আমি বললাম, ‘মানে।’ তিনি রেগে গেলেন, বললেন, ‘পত্রিকার পাতায় কেবল খুনখারাপি, ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য খবর আসছে? এসব দেখতে আর ভালো লাগে না। তারচেয়ে বরং পত্রিকাই পড়ব না।’ আমি চুপসে গেলাম। ‘ঠিকই তো।’ পত্রিকার পাতায় ভালো খবর কই। কেবল খারাপ সংবাদই চোখে পড়ে। অসংখ্য খারাপ খবরের সঙ্গে প্রতিদিনই আসছে ধর্ষণের খবর। তাও আবার শিশু ধর্ষণ! এর কারণ কী? উত্তরটা খুব কঠিন; তবে আমি মনে করি নীতিনৈতিকতার চূড়ান্ত অবনতি হলেই কেবল শিশু ধর্ষণের মতো জগন্য কাজ হতে পারে। নৈতিকতার প্রশ্নটি এ জন্যই আসছে, কারণ পত্রিকার মারফত শিশু ধর্ষণের যে চিত্র পাচ্ছি, তাতে দেখা যাচ্ছে শিশু ধর্ষণে এমন ব্যক্তিও জড়িত যারা বিবাহিত। শুধু তাই নয়, পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিও শিশু ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত। তাহলে এবার চিন্তা করুন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা এখানে কতটা দায়ী আর ব্যক্তির নীতিনৈতিকতা বা কতটা?

এবার আসুন, শিশু ধর্ষণের একটি প্রতিবেদন দেখে নেওয়া যাক : এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৫৫ জনের বেশি শিশু এমন পৈশাচিক বর্বরতার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ, এ তিন মাসের হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন প্রায় দুটো শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ধর্ষণের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ)। তাতে বলা হয়, ওই তিন মাসে মোট ১৭৬টি শিশু ধর্ষিত হয়েছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ৫৫টি করে এবং মার্চে ৬৬টি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। অর্থাৎ, মাসে গড়ে ৫৫টির বেশি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সেখানেই শেষ নয়, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে। এই পরিসংখ্যান অতীতের যেকোনো রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। ধর্ষিত ১৭৬ জন শিশুর মধ্যে এক থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ১৫ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ৩৭ জন এবং ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে রয়েছে ৫৭ জন। এ ছাড়া ৬৭ জন শিশুর বয়স কোনো সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়নি। ২৬৯টি বেসরকারি সংস্থার প্ল্যাটফরম বিএসএএফ। তারা মোট ১৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত শিশু অধিকার লঙ্ঘনবিষয়ক সংবাদ পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য প্রকাশ করে। সেখানে আরো বলা হয়, গত বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৪৫ শিশু। প্রথম তিন মাসে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেনি। তবে গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছর গণধর্ষণ এবং প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণ কমেছে যথাক্রমে ৫৫ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা বেশি ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আক্রান্তদের বেশির ভাগই মূলত দরিদ্র এবং শ্রমজীবী বাবা-মায়ের সন্তান। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জেলায়। ঢাকায় ২৫টি, চট্টগ্রামে এবং নারায়ণগঞ্জে ৯টি করে, খুলনায় ৬টি এবং যশোর ও সিলেটে ৫টি করে। ২০১৭ সালের হিসাবেও ঢাকা সবার আগে। এখানে ৬৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া গাজীপুরে ২৮টি এবং নারায়ণগঞ্জে ২৪টি। ধর্ষণে কম বয়সীদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও আশঙ্কাজনক। পত্রিকায় পাওয়া তথ্যে ধর্ষকদের বয়স পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৮ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে, ৫৬ জনের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ২০ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে এবং ১১ জনের বয়স ৪৫ বছরের বেশি। মূলত, বাংলাদেশে শিশুদের জন্য সার্বিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলছে। আর তা দিন দিন বাড়ছে। বেশির ভাগ ঘটনায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচার হলেও রায় কার্যকর না হওয়া বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগ শিশু দরিদ্র ও শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান। আমার আশঙ্কা, শিশু ধর্ষণের বাস্তব চিত্র উল্লিখিত পরিসংখ্যানের চেয়েও খারাপ। কারণ অন্যান্য অপরাধের মতো শিশু ধর্ষণেরও সব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। অনেক পরিবারই বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করে না। মূলত বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি ও ত্রুটিপূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়া, মানুষের নীতিনৈতিকতার মারাত্মক স্থলনের কারণেই শিশু ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুকে বিচার চাইতে গেলে এক অমানবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিকটিমকেই প্রমাণ করতে হয়, সে জঘন্য এক অপরাধের শিকার হয়েছে। মেডিক্যাল টেস্ট থেকে শুরু করে আইনজীবীর জেরা পর্যন্ত ভিকটিমকে যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়, তাতে অনেকেই মনোবৈকল্যের শিকার হয়। লিগ্যাল প্রসিকিউশনকে এখনো নারী বা শিশুবান্ধব করা যায়নি। বন্ধ করা যায়নি বিতর্কিত ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার কারণে দরিদ্র ও অসহায় পরিবারগুলো মামলা চালানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যেসব মামলা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে সেগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই রায় বাস্তবায়ন হয় না। এসবই অপরাধীর অপরাধ সংঘটনে অন্যায় উৎসাহ জোগায়।

শিশু ধর্ষণের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচার করে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দিয়ে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। বিচার প্রক্রিয়া হতে হবে শিশুবান্ধব। শিশু ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যেমন জরুরি, প্রতিটি মানুষের নৈতিকতার উন্নয়ন তেমনই জরুরি। আমি মনে করি শুধু আইন করেই শিশু ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না, যদি না মানুষের নৈতিক উন্নতি হয়। শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে সমাজে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আর বিষয়টি প্রকৃত অর্থেই জরুরি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist