হাসান জাবির

  ২৬ মার্চ, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ইস্পাতশিল্পে বাণিজ্যযুদ্ধ

লোহা এবং কার্বনের সংকর হচ্ছে ইস্পাত। লোহার সঙ্গে পয়েন্ট ফাইভ থেকে টু পয়েন্ট ফাইভ মাত্রার কার্বন মেশালেই সেটি ইস্পাতে পরিণত হয়, যা লোহার চেয়ে অধিক মজবুত ও শক্তিশালী। রেনেসাঁ উত্তর যুগে অবকাঠামো, জাহাজ নির্মাণসহ অনেক ক্ষেত্রেই ইস্পাতের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বর্তমান সময়ে ইস্পাত এক অপরিহার্য নির্মাণসামগ্রী। ছোট-বড় যেকোনো স্থাপনা অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ইস্পাতের ব্যবহার হচ্ছে। সংগত কারণেই ইস্পাতশিল্প বৈস্মিক বাণিজ্যে বড় একটি সেক্টর। জায়ান্ট করপোরেশনগুলোর বাণিজ্যিক আকর্ষণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ইস্পাতশিল্প। যেহেতু লোহার সঙ্গে কার্বন মিশিয়েই তৈরি হয় ইস্পাত। তাই ইস্পাতশিল্প সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যে লোহা এবং অ্যালুমিনিয়াম আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ইস্পাতের বড় ভোক্তা। আর দেশটি তার চাহিদার বেশির ভাগ ইস্পাত বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে থাকে। যদিও একসময় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রচুর ইস্পাত উৎপাদন হতো। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটির ইস্পাতশিল্প কারখানাগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। গত এক দশক থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের ইস্পাতশিল্প কারখানা সচল করার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছেন। গত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেশটির ইস্পাতশিল্প সচল করার অঙ্গীকার করেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। আর ওই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির আলোকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অভ্যন্তরীণ ইস্পাত উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে থাকেন। সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর শতকরা ২৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেন। আর এতেই ইস্পাত সংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলো তেতে ওঠে। ইস্পাত উৎপাদক দেশগুলো রীতিমতো বিপাকে পড়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত দেশটির অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বড় প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। পক্ষান্তরে দেশটির ইস্পাত আমদানি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বিপাকে। ইস্পাত আমদানিতে সরাসরি জড়িত শ্রমিক-মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে ইস্পাত রফতানি ও শীর্ষ উৎপাদক দেশগুলো ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান ইস্পাত সরবরাহকারী দেশগুলো এ ব্যাপারে একাট্টা হয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে সচেষ্ট হয়। তারা মনে করছেন নতুন মার্কিন সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিপন্থী। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে প্রধান ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশগুলো হচ্ছে কানাডা, মেক্সিকো, চীন, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর মধ্যে কানাডা ও মেক্সিকো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সরবরাহকারী দেশ। আবার পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশ চীন। দেশটি নিজের উৎপাদিত ইস্পাতের মাত্র ১০ শতাংশ রফতানি করে থাকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের ইস্পাত রফতানির পরিমাণ হছে দেশটির আমদানি চাহিদার মাত্র একভাগ। এ ক্ষেত্রে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র চাহিদার সিংহভাগ ইস্পাতই আমদানি করে থাকে, তাই বেইজিংয়ের বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশে এই অংশীদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংগত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে বেশি চটেছে বেইজিং। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় চীন এর কড়া প্রতিবাদ করেছে। এ ক্ষেত্রে দেশটি পাল্টা পদক্ষেপ নিতে কার্পণ্য করবে না বলে যুক্তরাষ্ট্রকে হুশিয়ার করেছে। শুধু চীন নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুমিত্র সবাই ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন এটিকে গুরুতর অসংগতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আলাদাভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে কানাডা, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান অস্ট্রেলিয়া সবাই। যদিও শেষ পর্যন্ত কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানির ক্ষেত্রে নতুন শুল্কহার আরোপের ক্ষেত্রে কিছুদিন সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত আমদানি সংশ্লিষ্টরা কিছুটা উপকৃত হবেন। একই সঙ্গে প্রধান দুই আমদানিকারক দেশ কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে স্থায়ী সমাধানের পথ তৈরিতে সহায়ক হবে।

তবে, সামগ্রিক পরিস্থিতি নাজুক। বিশেষত চীনের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে চীন পাল্টা পদক্ষেপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা অন্যান্য পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত না পাল্টালে চীন পাল্টা পদক্ষেপ নেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্য সয়াবিনের ওপর চীন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, চীন হচ্ছে পৃথিবীতে সয়াবিনের প্রধান ভোক্তা। আর চীনের সয়াবিন চাহিদার বেশির ভাগই পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রধান সয়াবিন রফতানিকারক। তাই এ-সংক্রান্ত যেকোনো পাল্টা পদক্ষেপ আরো কিছু পণ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা উভয় দেশকে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেবে। ইতোমধ্যে ইস্পাত ও সয়াবিন বাণিজ্যের যাবতীয় হিসাব-নিকাশে জড়িয়ে পড়ছে অনেক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রে ইস্পাত রফতানি কমে যাওয়ার আশঙ্কায় দেশটির রাজনৈতিক মিত্ররাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় তারাও ওয়াশিংটনের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। ইস্পাত রফতানিকারক দেশগুলো একাট্টা হয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার শরণাপন্ন হলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠবে, যা বিশ্ববাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। আর এ ধরনের পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের সম্ভাব্য সব প্রতিক্রিয়াই নয়া বাণিজ্যযুদ্ধের পূর্বাভাস বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

দীর্ঘদিন থেকেই দুনিয়ায় যে নয়া বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তার একটি প্রচ্ছন্ন নমুনা পাওয়া যাচ্ছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। এই নয়া বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি দুনিয়ার অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা ভেঙে দিতে পারে, যা থেকে বাণিজ্যিক সংকটের সূচনা হলে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে উন্নয়নশীল বিশ্বে। অর্থনৈতিক বিরোধের সূত্রধরে রাজনৈতিক বিরোধের মাত্রাও বেড়ে যাবে। ফলে দুনিয়ার মেরুকরণ পাল্টে গিয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়বে। আর অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ইস্পাত বাণিজ্য ঘিরে অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলোর বিরোধের দ্রুত সুরাহা প্রয়োজন। কেননা বর্তমান দুনিয়ায় ইস্পাতবহুল ব্যবহৃত একটি পণ্য। বাংলাদেশেও ইস্পাত ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রতি বছর প্রায় ১০ শতাংশ হারে ইস্পাতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্য দেশগুলোর অবস্থাও একই রকম। তাই ইস্পাত বাণিজ্য ঘিরে আজকের সংকট যদি আরো প্রসারিত হয়, তার নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উন্নয়নশীল বিশ্ব। আবার বড় দেশগুলো এ পণ্যের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের গতিপথে নানামাত্রার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলো জাতীয় পরিস্থিতি অনুকূল রাখতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য বাণিজ্য বিরোধ উভয় দেশ নিজেদের প্রয়োজনেই মিটিয়ে ফেলবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। আর এমনটি হলে সবার জন্যই মঙ্গলজনক। কিন্তু ইস্পাতের শুল্ক আরোপ ঘিরে দুদেশের সাম্প্রতিক বাণিজ্য বিরোধ অব্যাহত থাকলে সেটি নয়া বাণিজ্যযুদ্ধের সূত্রপাত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সে কারণে ইস্পাতশিল্পকে ঘিরে নয়া বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

লেখক : গবেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist