অলোক আচার্য্য

  ০৬ মার্চ, ২০১৮

সংস্কৃতি

বইপড়া : অভ্যাস ও বাস্তবতা

বইপড়ার শখ অন্য সব শখ থেকে ভালো। অনেকেই বইপড়াকে নিজেদের শখ বলে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে শখের বশে কতটা বইপড়াকে আপন করে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। একটা সময় ছিল যখন বইপড়ার প্রতি ছেলেমেয়েদের মধ্যে তীব্র আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। বই হাতে পেলেই তা পড়ে দেখার এক ধরনের কৌতূহল ছিল লক্ষণীয়। তবে আমি এটা বলছি না, সবার মধ্যেই এ প্রবণতা ছিল। কিন্তু তা এখনকার চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল বলে ধারণা। কিন্তু আমার মনে হয়, আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বইপড়ার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। নতুন বই পেলে যে এক ধরনের মুগ্ধতা তৈরি হয়, তা ঠিক আছে। কিন্তু কয়েক মাস যেতেই না যেতেই সেই মুগ্ধতা আর থাকছে না। মূল বই থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ঝুঁকছে গাইডবই, লেকচারশিট, প্রাইভেট এসবের প্রতি। এসব কিছুই অবশ্য পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য। পাস করা, ভালো ফল করা এসবই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য! অবশ্য আজকালকার সচেতন অভিভাবক মাত্রই সন্তানের ভালো ফল আশা করেন। আমিও করি। কিন্তু ভালো ফল করতে গিয়ে যদি পাঠ্যবইয়ের বদলে গাইড বা প্রাইভেট বা লেকচারশিটের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়, তবে সেটা একদমই ভালো কথা নয়। তারপর আবার এসবের বাইরে গিয়ে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতা এসবের ভেতরে যে জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভা-ার আছে, তার খোঁজ এরা করছে না। তার কারণও কি শুধুই পরীক্ষায় ভালো ফল? ফলে জ্ঞান হয়ে পড়ছে সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে মুক্ত আকাশের সন্ধান মেলে কি? শুধু পাস করা বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে (প্রাইভেট বা কোচিংয়ে বেশি সময়) ভালো ফল করা যায় বৈকি, তবে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় কি? মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে মুক্তজ্ঞানের চর্চা থাকা আবশ্যক।

আজকাল প্রায়ই চোখে পড়ে বইয়ের বদলে ক্লাসের বাইরে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে, মোবাইল বা ট্যাবে গেমস খেলে বা অপ্রয়োজনীয় কিছু ওয়েবসাইটে ঢুকে সময় কাটাচ্ছে। তাতে আমি মর্মাহত হই। কারণ এতে তাৎক্ষণিক মনের আনন্দ মিটছে; কিন্তু মাথার ভেতর থেকে বইপড়ার ধৈর্যটা কমে যায়। বিষয়টা এমন, একজন ছাত্র যখন তার মুঠোফোনের স্ক্রিনের দিকে যে তীব্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে, সেই আগ্রহ যদি বইয়ের পৃষ্ঠার প্রতি থাকত তাহলে কত ভালোই না লাগত। তবে বিষয়টা শুধু আমার ভালো লাগা বা মন্দ লাগার না, বিষয়টা জাতির ভবিষ্যতের। আমাদের মুঠোফোনের দরকার আছে, কিন্তু মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়–য়া একজনের দিনের কয়েক ঘণ্টা মুঠোফোনের সঙ্গে কাটানো কতটা প্রয়োজন আছে, তা বোধগম্য নয়। এর অর্থ আমরা প্রযুক্তির বিপক্ষে নই। সে ইচ্ছাও নেই। কারণ বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানবসভ্যতা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। চিন্তা, এর সঠিক ব্যবহারের ওপর।

একটা কথা প্রায়ই মনে হয়। বহু বছর ধরেই এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আর তা হলো আমরা সবাই মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও সারাজীবন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি। কেউ কেউ সফল হই। তবে সবাই পারি কি? মানুষ হওয়ার জন্য এত শ্রম, এত অধ্যবসায়, এতটা সাধনার প্রয়োজন হয়, লেখাপড়া করে একটা ভালো চাকরি পেতেও বোধ করি তার তিলকটুকুও দিতে হয় না। সেই যে ছেলেবেলায় ভাবসম্প্রসারণে পড়েছিলাম ‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি কিন্তু মানুষ প্রাণান্ত চেষ্টায় মানুষ। এই প্রাণপণ চেষ্টাটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হয়। নতুবা মানবকুলে জন্ম নিয়েও মানুষ হিসেবে বিদায় নেওয়াটা অসম্ভব হয়ে ওঠে।’ এটাকে সম্ভব করে তোলার জন্য পাঠাভ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। তবে এ সময়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেন জানি বইপড়ার আগ্রহ অনেকাংশে কমে গেছে। হাতেগোনা কয়েকজন সিলেবাসের বাইরে এসব বই পড়তে আগ্রহী। বইপড়ার অভ্যাস তৈরি কাজটি সহজ নয়। জোর করে ওষুধ খাওয়ানো যায়, সে ওষুধ কাজও করে; কিন্তু বই পড়ানো যায় না। আর গেলেও তা হজম হয় না। বরং এই জোর করার ফল উল্টো হতে পারে। বইয়ের প্রতি স্থায়ী বিরক্তিভাব জন্মাতে পারে, যা দূর করা আরো বেশি কষ্টসাধ্য।

বইপড়া বিষয়টি তখনই স্বাভাবিক মনে হবে, যখন ভেতর থেকে এক ধরনের তৃষ্ণা জাগ্রত হবে। তিনবেলা খাওয়ার জন্য আমাদের যে হাহাকার, একবেলা হঠাৎ না খেলে যে ক্ষুধাবোধ, তেমনি একবেলা বই না পড়লে যদি সে রকম কোনো বোধ হয়, তখন বইপড়াটা মজ্জাগত হবে। অর্থাৎ অতিরিক্ত কোনো কাজ হিসেবে নয়, বরং আর দশটা স্বাভাবিক কাজের মতোই বইপড়া একটি স্বাভাবিক কাজ হবে। খেলাধুলা বা বিনোদন লাভের উপায় যেমন আমাদের আনন্দের উৎস, তেমনিভাবে বই যদি আমাদের আনন্দ উপকরণ হতে পারে, তখন তা হবে মনের ক্ষুধা মেটানোর অন্যতম অনুষঙ্গ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist