অলোক আচার্য

  ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

নিবন্ধ

শুদ্ধ ভাষাচর্চা ঘনীভূত হোক

যথাযথ মর্যাদায় পালিত হলো ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিবস পালনে জাতির আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না। কোনো বছরই তা থাকে না। কিন্তু কেবল দিবসের মধ্যে ভাষাচর্চা সীমাবদ্ধ রাখলে তা একসময় আত্মঘাতী হবে। পৃথিবীতে বহু ভাষা আজ বিলুপ্ত। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের যে ইতিহাস আছে তা নিয়ে আমরা গর্বিত। কিন্তু এই এক দিন পার হলে বাংলা ভাষার ব্যবহারের যে ধরন তা নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত হতেই হয়। এক ধরনের অবহেলা আর অনাদরেই সারা বছর ব্যবহৃত হয় বলা চলে। ভুল আর বিকৃত বানানে দেশের সর্বত্রই এই ভাষার ব্যবহার চোখে পড়ে। এমনকি এই ২১ ফেব্রুয়ারিতেও বহু স্থানেই হিন্দি গান শুনতে পাই। এটা অবশ্য আজকাল অনেকের কাছেই কেবল বনভোজন করার উপলক্ষে পরিণত হয়েছে। গান বাজিয়ে, উল্লাস করে এই প্রজন্মের অনেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করে। এদের অনেকেই জানে না ভাষার সঠিক ইতিহাস। অনেকেই স্মরণ করার থেকে নিজের ছবি ফেসবুকে আপলোড করতেই বেশি আগ্রহী থাকে। এসব দেখে মনে হয়, আমরা এসব করে বাংলাকে কেবল দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলছি। ফেব্রুয়ারি এলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের কথা। বাংলা সমৃদ্ধিশালী ভাষা হলেও আমাদের কারণেই কোথায় যেন একটা ঢিলেঢালা ভাব চোখে পড়ে। হতে পারে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশি ভাষা বললে প্রথমেই আসে ইংরেজি ভাষার কথা। এই ভাষাকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় যে মনে করা হয় এটা ভালোভাবে আয়ত্ত না করলে জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে। তার মানে এই না যে ইংরেজি বা অন্য ভাষা শেখার গুরুত্ব নেই। তাই বলে নিজ ভাষাচর্চার ওপরে অবশ্যই নয়।

ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। বংলা ভাষার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ কতখানি তা পরিমাপের একটা চেষ্টা করা হয়। আসলেই বিষয়টা এমন হওয়া উচিত? সারা বছর বাংলা নিয়ে চর্চা হবে। সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করার চেষ্টা করা হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা মোটা মোটা বিদেশি সাহিত্যের বই নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকবে না। এর একটা অংশ বাংলা বই নিয়েও কাটাবে। মোট কথা শুধু কাগজে-কলমে নয় অন্তরে স্থান দিতে হবে বাংলাকে। তাহলেই অন্তর হবে শুদ্ধ। আর শুদ্ধ অন্তর দিয়ে যে ভাষাই আয়ত্ত করতে চাও না কেন তা সম্ভব।

এবার একটু বাংলা বানানের কথায় আসি। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখেছি বানান ভুল হলে মার্কস কেটে নেওয়া হতো। আমরা অতি সতর্কতার সঙ্গে ইংরেজি বানান মুখস্থ করার মতো করেই বাংলা বানান মুখস্থ করতাম। যাতে পরীক্ষার খাতায় বানানের জন্য কোনো মার্কস কাটা না যায়। বানান ভুল হলে শিক্ষকরা তার নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে দিত। বাড়িতে যখন সে খাতা দেখাতাম খুব লজ্জায় পড়ে যেতাম। বলা চলে, ঘাড় ধরে সেই বানান শেখানো হতো। ফলে এমন হতো যে যেখানে ভুল বানান চোখে পড়ত মনে হতো সৌন্দর্যের একটা অভাব রয়েছে। তার মানে আমার যে ভুল হয় না তা না। তবে তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত। অনেক দোকানের ব্যানারে, রাস্তাঘাটের বিভিন্ন লেখায়, দেয়ালে দেয়ালে তাকালে চোখে পড়ে বানান ভুলের ছড়াছড়ি। দেখলে মনে হয় এরা যেন ভুল বানানের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অবশ্য বাংলা বানান সঠিক লেখার ওপর শহরের স্কুলগুলোয় কী হয় তা জানি না, তবে মফস্বলের অনেক স্কুলেই যে বিষয়টার প্রতি সুনজর দেওয়া হয় না তা জানি। একদিন ক্লাস্টার এক ট্রেনিংয়ে আমি প্রশিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলাম, বানান ভুলের জন্য মার্ক কাটা যাবে কিনা? প্রশিক্ষক মহোদয় চোখ কপালে তুলে বললেন, মার্ক কেন কাটবেন? সে যে লিখতে চেষ্টা করেছে তাই তো যথেষ্ট। তার মানে লিখতে চাওয়াটাই আমার ভাগ্য। কিন্তু সে যে সঠিকটা শিখতে পারল না এটাই কষ্ট থেকে গেল। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, মুঠোফোনে বাংলিশ টাইপের এসএমএস দেখলে আমার ঠিক কী পরিমাণ কষ্ট হয় তা বলে বোঝাতে পারব না। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার কবে কার্যকর হবে জানি না। আমাদের বড় বড় অফিসে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তার অবশ্য কারণও আছে। যে বিদেশি ভাষা ভালো বলতে পারবে সোসাইটিতে তার দামও আজকাল বেশি দেওয়া হয়। কিন্তু শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারা একজন বাঙালির দাম কতটা। কবি সেই কবেই মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করে গেছেন। প্রথম জীবনে পরভাষায় সাহিত্যচর্চাকারী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বুঝতে পেরেছিলেন শিকড় ছেড়ে যে কা-ের খোঁজে ছুটেছিলেন তার কী যন্ত্রণা। দেশে ফেরার পর তো তার কলমের শুধু ইতিহাস। মাতৃভাষার গুরুত্ব এত সাবলীলভাবে তার বিভিন্ন কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছেন তা সবার জানা। সনেট কবিতার জন্ম দিয়ে তিনি আলাদা একটা ধারার জন্ম দিলেন। নিজের ভাষা সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে না পারলে ভিনদেশি ভাষা যে আয়ত্ত করা কঠিন সে অতি খাঁটি কথা।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের সেই মহান আত্মত্যাগ, সারা বিশ্বে আন্তÍর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এসব কিছুই বাংলাকে নিয়ে গর্ব করার মতো যথেষ্ট। এ ছাড়া এ ভাষা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বলার অনেক কিছু আছে। আমরা দরিদ্র নই। আমরা সমৃদ্ধ। আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ। দরকার শুধু মুখের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর দিয়ে লালন করার ক্ষমতা। দেশে অনেক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। সেখানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার সঠিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ হলে ভালো হয়। আমি বারবার বলছি বর্তমান যুগে চলতে গেলে বিদেশি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে; কিন্তু তা যেকোনোভাবেই মাতৃভাষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে তা আমি মানতে নারাজ। আমাদের প্রজন্ম, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। স্কুলগুলোয় শুধু ইংরেজি বা অঙ্ক বা বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি ভীতিসূচক গুরুত্ব না দিয়ে পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ এসব বিষয়কে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করতে হবে। বাংলা ভাষাচর্চার গুরুত্বকে কেবল দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছর সঠিক ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist