আখতার হামিদ খান

  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা

মহান ভাষা আন্দোলন বাঙালির জীবনে সবচেয়ে তাৎপর্যময় ঘটনা। বাঙালির পরবর্তী ইতিহাস বিশেষ করে আমাদের স্বাধিকার, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচক হিসেবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে আখ্যায়িত করা যায়। একুশে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বহু গুণে ইতিহাসের একটি মাইলফলক। একুশের রক্তস্নাত অধ্যায়ের ফলেই রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মুক্ত হয়।

১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে ১৯৫৬ সালে শেষ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শেষ হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ কাজটি বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বটি সম্পন্ন হবে বলে আমার বিশ্বাস। মানুষ মননশীল ও সামাজিক জীব। সেভাবে চিন্তা করে, স্বপ্ন দেখে ও কল্পনা করে। মানুষ তার ভাবনা, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা ভাষার মাধ্যমে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হয়। অর্থাৎ ভাষা মানুষের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা ও মনোভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠধ্বনির সাহায্য গ্রহণ করে। আবার কখনো কখনো হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ইঙ্গিত করে থাকে। কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ যত বেশি পরিমাণ মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, ইঙ্গিতের সাহায্যে ততটা পারে না। কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মানুষ মনের সূ²তিসূ²ভাবও প্রকাশ করতে সমর্থ হয়।

আদিম যুগের মানুষ আকার ও ইঙ্গিতে পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান করত। এভাবেই কালের বিবর্তনে ভাষার উৎপত্তি হয়। মানুষ যেদিন থেকে পৃথিবীতে আছে, ভাষাও সেই দিন থেকেই আছে। কিন্তু আদিমকালের ওই শুরুর ভাষা সাজানো গোছানো ছিল না। মানুষ এখনকার মতো ভাষা পেয়েছে আরো পরে। অভিব্যক্তির নানা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষ আজকের ভাষা পেয়েছে।

প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষার জন্ম নিয়ে চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভাষার জন্ম জীবের জন্মের মতো নয়। অমুক সন-তারিখে অমুক ভাষার জন্ম হইয়াছে; এইরূপ কথা বলিতে পারি নাই। ভাষা নদী প্রবাহের ন্যায়। বিভিন্ন স্থানে তাহার বিভিন্ন নাম। যখন একটি ভাষা প্রবাহের মধ্যে কোনো সময়ের তাহার পরবর্তী ভাষাভাষীদিগের নিকট একটি নতুন ভাষা বলিয়া বোধ হয় তখন তাহার নামকরণ হইয়া থাকে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘ভাষা সম্ভবই হতো না, যদি না মানুষের স্বভাবের মধ্যে ভাষার বীজ থাকত। মানুষের সৃষ্টির সঙ্গেই তার মধ্যে এই ভাষার বীজ রেখে দিয়েছিলেন। এই হিসেবে ভাষাকে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার দান বলা যেতে পারে। কিন্তু এই বীজ কী? সেটি হচ্ছে প্রতিটি জিনিসের অনুভ‚তির সঙ্গে মানুষের গতি প্রবৃত্তি। একটা বাঘ বা সাপ দেখলে মানুষ পালাতে চায়; জল দেখলে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য সেদিকে যেতে চায়, মানুষ শব্দ শুনলে শব্দের দিকে কান বাড়িয়ে দেয়। যখনই অনুভ‚তি স্মরণে আসে, তখনই আগের গতি প্রবৃত্তিও জেগে ওঠে। যখন মানুষের গতি প্রবৃত্তি অঙ্গভঙ্গি থেকে বাগযন্ত্রের গতিতে পরিণত হলো, তখনই প্রথম ভাষার উৎপত্তি হলো। প্রথমে গতি, পরে অঙ্গভঙ্গি শেষে ভাষা। এই হলো ভাষার জন্মকথা।’ ভাষাবিজ্ঞানী ড. সুকুমার সেন বলেছেন, ‘ভাষা মানুষের জন্মসূত্রে পাওয়া, তা এতই স্বাভাবিক যে, চলাফেরা বা শ্বাসক্রিয়ার মতো স্বয়ংক্রিয় বৃত্তি বলিয়া মনে হয়Ñমানুষের উচ্চারিত অর্থবহ, বহুজনবোধ্য ধ্বনির সমষ্টিই ভাষা।’

পৃথিবীতে অনেক ভাষা আছে। পৃথিবীর সব মানুষ একই বাক-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ধ্বনি সৃষ্টি করে, তবু এক এক গোষ্ঠীর ভাষা শৃঙ্খলা ও ভাষাবৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকম হয়। তাই একেক জাতি ও দেশের ভাষা একেক রকম হয়। আমাদের ভাষার নাম বাংলা ভাষা, আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা হলো সেই ভাষা যে ভাষা মানুষ জন্মের পর থেকেই শোনে, মায়ের কোল থেকে শেখে, পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে আয়ত্তে আনে। অর্থাৎ মাতৃভাষা হচ্ছে মায়ের ভাষা। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, কারণ বাংলা ভাষাতেই আমাদের কথা বলেন। আমাদের জন্মের পর আমরা প্রথম মায়ের কাছ থেকে এই ভাষার কথা বলে আসছি। পৃথিবীর ভাষাগুলোর মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার একটি বিশিষ্ট স্থান ও মর্যাদা বিদ্যমান। বিশ্বের প্রায় ২০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর বড় ভাষাগুলোর একটি। এই ভাষা সারাবিশ্বে সপ্তম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।

মাতৃভাষা বাংলার ওপর বিভিন্ন সময় নেমে আসে দুর্যোগ। এ দেশের আপামর জনসাধারণ বাংলা ভাষায়ই বলেছে। তারা বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে মাতৃভাষা রূপে মেনে নেয়নি। বাংলা ভাষার জন্য বাঙালি মুসলমানদের গভীর মমত্ববোধ থাকলেও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে একটি প্রশ্ন উঠেছিল ‘বাংলা কী বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা’ বাঙালি মুসলমানদের উচ্চবিত্ত অংশটিই এই বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। তাদের মানসিকতা ছিল ‘আশরাফ’ অর্থাৎ উচ্চ শ্রেণির মুসলমানদের ভাষা উর্দু আর ‘আতরাফ’ অর্থাৎ নি¤œ শ্রেণির মুসলমানদের ভাষা বাংলা। এদের এই হাস্যকর, বিভ্রান্তিমূলক কল্পনাও মনোভাবকে উদ্দেশ করে মাওলানা আকরম খাঁ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে নানা ধরনের উদ্ভ‚ত প্রশ্ন আছে, ইহার মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত।’

রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষারই বিজয় সূচিত হয়েছে। সব বাকবিতÐার অবসান ঘটিয়ে বাংলা ভাষা মাতৃভাষারূপে স্থান করে নিয়েছে। সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের বৈপ্লবিক আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এ ভাষা পেয়েছেন নতুন গতি। এ ব্যাপারে ভাষা গবেষক ও ভাষাকর্মী মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ বলেন, ‘এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষা বাংলাতেই কথা বলে আসছে যুগযুগান্তর ধরে। যেহেতু জন্মের অব্যবহিত পরে এবং কালক্রমে তারা মায়ের মুখে এই ভাষা শুনেছে এবং পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ থেকে তা আহরণ করেছে, আয়ত্তে এনেছে, সে কারণে এক রূপ অবলীলায়ই তারা তাদের ভাষাকে মাতৃভাষারূপে কল্পনা করার অবকাশ যেমন তাদের ঘটেনি, তেমনি বাংলা ভাষা তাদের মাতৃভাষা কি-নাÑএই প্রশ্নও মনে জাগেনি। কেননা মাতৃভাষা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গী এবং অদ্বিতীয় সত্তার মতো। ...কিন্তু তা সত্তে¡ও মুষ্টিমেয় শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত মানুষের মনে বিভিন্ন যুগে এ-সংক্রান্ত প্রশ্ন জেগেছে এবং নানা দ্ব›দ্ব-সংশয় জন্ম নিয়েছে। বাংলা ভাষা বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা কি-না-এই প্রশ্ন এবং এ নিয়ে দ্ব›দ্ব-সংশয়, বাকবিতন্ডা আধুনিককালেই সবচেয়ে বেশি ব্যাপ্তি লাভ করেছে।’

বিদেশি ভাষা ও সাংস্কৃতিকচর্চা করে আমরা যতই দক্ষতা লাভ করি না কেন আসলে প্রত্যেক মানুষকে প্রথমে মাতৃভাষারই সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। মাতৃভাষায় চিন্তা করেই প্রত্যেক মানুষকে বিদেশি ভাষায় তার অনুবাদ কিংবা রূপান্তর করতে হয়। মাতৃভাষার অবলম্বন ছাড়া এই রূপান্তর সম্ভম নয়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। আমাদের হৃদয়ের গভীরে এর স্থান। বাংলা ভাষা আমাদের প্রথম ঠিকানা, আমাদের শেকড়, আমাদের জীবন। আমাদের কাছে এই ভাষা মাতৃস্তন্যস্বরূপ। এই ভাষার রস পান করেই আমরা প্রাণবান মানুষ হয়ে বেড়ে উঠছি। অতএব মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া আমাদের উন্নতি ও বিকাশ সম্ভব নয়। রাষ্ট্রভাষা হলো রাষ্ট্রের ভাষা, রাষ্ট্র প্রবর্তিত ভাষা। একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা সে দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, গণতন্ত্র, রাজনীতি, জাতীয়তা, স্বতন্ত্রবোধসহ সব পরিচয় ফুটে ওঠে। এই ভাষার মাধ্যমে অফিস-আদালতের কাজ চলবে, শিক্ষা, শিল্প-বাণিজ্য, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শনসহ সব বিষয়ে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকবে। যেকোনো দেশের রাষ্ট্রভাষা সে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বের প্রহরী হিসেবে কাজ করে। মাতৃভাষা যেমন জাতির অতুলনীয় সম্পদ, তেমনি রাষ্ট্রভাষাও জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কাজেই কোনো দেশের মাতৃভাষার দাবিই সে দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়াটা অধিক যুক্তিসংগত এবং বাস্তব সত্য।

রাষ্ট্রভাষা বিতর্কটি ব্যাপকতা পায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। কিন্তু এই বিতর্কের শুরু আরো অনেক পূর্ব থেকেই। বাংলা ভাষাভাষীদের মাতৃভাষা যাতে রাষ্ট্রভাষার আসনে সমাসীন হতে না পারে সে জন্য ষড়যন্ত্র চলেছে দীর্ঘদিনব্যাপী। বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ-ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে নতুন করে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে যাই হোক বাংলাদেশে বাংলাই হবে সরকারি ভাষা।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের ব্যাপারে লাহোর প্রস্তাবের ভ‚মিকা অনবদ্য। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষাবিষয়ক এই স্বপ্নপূরণের মহাসুযোগ এনে দেয় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত ভ‚ভাগ এবং হিন্দু অধ্যুষিত অবশিষ্ট অংশগ্রহণ করে তা শুধু উপমহাদেশের স্বাধীনতার বাস্তব পথই উন্মুক্ত করে দেয় না, বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অপূর্ব সুযোগও সৃষ্টি করে দেয়।’ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা যেমনভাবে উচ্চারিত হচ্ছিল ঠিক তেমনি বাংলাকে বাদ দিয়ে হিন্দি ও উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তও চলছিল সমভাবে। এ দেশের শিক্ষিত শ্রেণিই সেই বিতর্ক ও চক্রান্তের জন্ম দেয়।

ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ একদিনে হয় না। নদী যেন বাঁকে বাঁক মোড় নিয়ে এঁকেবেঁকে পাহাড়, প্রান্তর, বনাঞ্চল পেরিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়, বাংলা ভাষাও তেমন চলমান নদী প্রবাহের মতোই ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল নিয়ে নানামত প্রচলিত আছে। বাংলা ভাষা কোন ভাষা থেকে এসেছে তা নিয়েও মতভেদ লক্ষ করা যায়। একসময় একটা ধারণা প্রচিলত ছিল, সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। কথাটি বলার কারণ হলো, বাংলা ভাষায় আমরা যেসব শব্দ ব্যবহার করি তার অধিকাংশ শব্দ সংস্কৃত ভাষার। কিন্তু পরে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এ তথ্য সঠিক নয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ ব্যাপারে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতির দুহিতা নয় তবে দূরসম্পর্কের আত্মীয়।’ বাংলা ভাষার সূচনা করেন বৌদ্ধগণ। বাংলাদেশে বৌদ্ধশাসনের অনুক‚ল পরিবেশই বাংলা ভাষার গোড়াপত্তন হয়। প্রখ্যাত ভাষাতত্ত¡বিদ ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, সুকুমার সেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ বাংলা ভাষার প্রধান প্রধান ভাষা পÐিতরা এই সত্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ‘সুলতান আমলে বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থের ভ‚মিকায় অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল হাই বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পাল রাজাদের আমলে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। বৌদ্ধগণ ও দোহাগুলো সেকালের বাংলা ভাষার নিদর্শন।’ সুকুমার সেন বলেছেন, ‘বাংলা ভাষার আদিস্তরের স্থিতিকাল আনুমানিক দশম হইতে মধ্য চতুর্দশ শতাব্দ। আদিস্তরের অর্থাৎ প্রাচীন বাংলার প্রধান নিদর্শন হইতেছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙালা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা নামক বইটির প্রথম গ্রন্থ চর্যাশ্চর্য বিনিশ্চিয় অংশে সংকলিত চর্যাপদগুলি।’

ভাষা পÐিতদের মতে, প্রাকৃত জনসাধারণের আদিম প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষা প্রাকৃত ভাষা, প্রাকৃতজনের ভাষা। বাংলা ভাষার আদি জননী হলো প্রাকৃত ভাষা। এই প্রাকৃত বা প্রাকৃতজনের ভাষা ছিল অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন। পূর্বাঞ্চলের ভাষা-পূর্বী প্রাকৃত থেকে গৌড়ীর প্রাকৃত ও তারপর নানা ভাষার সংস্পর্শে এসে ও শব্দ আহরণ করে বর্তমানকালের বাংলায় পরিণত হয়েছে। সংস্কৃতজ্ঞ অভিজাত শ্রেণির চোখে যারা ছিল নীচ শ্রেণির সাধারণ লোক তাদেরই ওরা নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাকৃতজন’। প্রাকৃত কথাটির অর্থ হলো স্বাভাবিক বা প্রকৃতি থেকে আগত। অর্থাৎ জনসাধারণের ভাষা। এই প্রাকৃত ভাষাটি কালক্রমে আরো ‘প্রাকৃত’ হয়ে গিয়েছিল সাধারণ লোকের মুখে মুখে বিবর্তন লাভ করে। তার সেই পরবর্তী রূপের বেশ মানানসই এক নাম ‘অপভ্রংশ’। এই অপভ্রংশের পূর্বী অর্থাৎ মাগধী রূপ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। বাংলা ভাষার উৎপত্তি প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বাঙালা ও তাহার সহোদরা হিন্দি প্রভৃতি ভাষা প্রাচীন পাক-ভারতীয় আর্য ভাষা হইতে উৎপন্ন সত্য। কিন্তু তাহার কথ্য রূপই ইহাদের মূল। ইদাদিগকে আমরা আদিম প্রাকৃত বলতে পারি...আদিম প্রাকৃত হইতে তিনটি স্তরের মধ্য দিয়া আমাদের বাঙালি ভাষা উৎপন্ন হইয়াছে। প্রথম স্তর পালির, দ্বিতীয় স্তর নাটকীয় প্রাকৃতের এবং তৃতীয় স্তর অপভ্রংশের সমশ্রেণিস্থ।’ কাজেই ভাষাবিদদেরে সংজ্ঞার আলোকে এ কথা সুস্পষ্টভাবেই বলা যায়, আদিম প্রাকৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম।

বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ লাভ করে বৌদ্ধযুগে পালবংশের রাজত্বকালে ৭৫০-১১৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বৌদ্ধ শাসকদের রাজত্বকালে বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটতে থাকে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হলো চর্যাপদ। ১৯০৭ সালে পÐিত হল প্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের মিউজিয়াম থেকে চর্যাপদ উদ্ধার করেন। চর্যাপদ রচনা করেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মযাজকরা। এগুলো বাংলা ভাষার ও বাংলা সাহিত্যে আদিমরূপে অতি মূল্যবান নিদর্শন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হয়ে আছে। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর আমরা হাজার বছর আগের বাংলা ও বাঙালির কথা জানতে পারি। বাংলা ভাষা বিকাশে বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক যেমন : মহাকবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান, শাহ গরীবুল্লাহ, নিধুগুপ্ত, রামমোহন রায়, আবদুল হাকিম, দৌলত উজীর, শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, শেখ সাদী, লালন শাহ প্রমুখের অবদানের কথাও স্মরণীয়। আধুনিক বাংলা ভাষার স্থপতিদের মধ্যে প্রধান প্রধান কবি সাহিত্যিক হলে ঈশ্বরচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদদীন প্রমুখ। তারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধির স্বর্ণ শিখরে নিয়ে যান। আজকের অতি আধুনিক কবি, সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষার যে প্রাণময়, দ্বীপ্তিময় ও ঐশ্বর্যমন্ডিত ধারা সৃষ্টি করেছে, তাতে বাংলা ভাষা বিশ্বভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলা ভাষা শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্পদে পরিণত হয়েছে। আমাদের ভাষা ও সাহিত্য এখন একটি স্বাধীন জাতির মানসিক ও সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষা মূর্ত করে এগিয়ে যাচ্ছে নব নব সৃষ্টির সন্ধানে।

দেশ বিভাগের পর বাংলা ভাষার চরম বিপর্যয়ের মুখে এ দেশের ভাংলা ভাষাপ্রেমী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় অধ্যায় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারি শহিদদের রক্তস্নাত আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলা ভাষার পরিপূর্ণ বিকাশ হয়। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই ঐতিহাসিক সত্যকে উপলব্ধি করে যথার্থই বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে উচ্চস্থানের অধিকারী করিয়াছে। পাক-ভারত উপমহাদেশের দুটি বিশিষ্ট প্রদেশের হিন্দু মুসলমানদের মিলিত প্রতিভা ইহাকে একটি বিশ্বভাষায় পরিণত করিবে।’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই মর্মবাণী আজ বাস্তব সত্য। বাংলা ভাষা বিকশিত হয়ে আজ বিশ্বভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে।

ভাষা আন্দোলন মানে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের রয়েছে এক গভীর ও চিরন্তন সম্পর্ক। বাংলা ভাষাকে পূর্ণতম রাষ্ট্রীয় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ছিল সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষাভাষীদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। সে রকম একটি রাষ্ট্র হলো বাংলাদেশ-বাংলা ভাষার ওপর ভিত্তি করে যার জন্ম। ১৯৫২ সালে একটি রক্তস্নাত আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ১৭ দিনের মাথায় তমুদ্দুন মজলিস নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১। এই চব্বিশ বছরে ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মি ও পূর্ব প্রস্তুতি। এ যুদ্ধের অর্জন, প্রাপ্তিত ও বিজয় আমাদের সাহস জুগিয়েছে সামনে এগোনোর। একুশের চেতনা আমাদের প্রাণে যে বিদ্রোহের দাবানল ও অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত করেছে তার আলোকবর্তিতা হলো ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতাপিপাসু বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল ভাষা আন্দোলন। অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির প্রথম পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ।

ভাষা সংগ্রামের প্রথম পথযাত্রা শুরু করে জাতীয় চেতনার যে বৈপ্লবিক মাটি তারা আমাদের জন্য উর্বর করে তুলেছেন, সেই মাটিতে ক্রমাগত রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বীজ বুনেছি আমরা, চয়ন করেছি স্বাধীনতার ফসল। বায়ান্নর একুশের ভাষা আন্দোলন থেকে সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিণতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম জাতিরাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist