রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

অভিবাসন প্রক্রিয়া ও সুশাসন

বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসনের অভাব রয়েছে দাবি করে সম্প্রতি টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশগামী পুরুষদের ৯০ শতাংশই দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অচিরেই বাংলাদেশের কর্মী পাঠানোর নবযাত্রা শুরু হবে। বিভিন্ন শ্রমবাজারের সমস্যার ধরন তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, অনেক সময় বিভিন্ন দেশ আমাদের দেশ থেকে চিকিৎসক নেওয়ার চাহিদা পাঠায়। কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসকরা স্বল্প বেতন দেখে যেতে চান না। তারা সেখানে গেলে তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি পেত। তিনি আরো বলেন, জাপান আমাদের দেশ থেকে কর্মী নিয়োগে আগ্রহী। আমরা দক্ষ কর্মী পাঠানোর চেষ্টা করছি। প্রথম ব্যাচ যদি দক্ষ হয় তবে আমাদের দেশের সুনাম হবে। তখন আরো বেশি করে কর্মী নিয়োগে আগ্রহী হবে। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করবেন বলেই শেষ। তা ছাড়া মালয়েশিয়ার অনুরোধে সে দেশে কর্মী পাঠানোর জন্য সরকারি পর্যায়ে জিটুজি পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। ওই পদ্ধতিতে প্রত্যেকে ২৭ হাজার টাকা দিয়ে ১০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার বেসরকারি খাতের যোগসাজশে জিটুজি পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানোর চাহিদা বন্ধ করা হয়। এখন বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে জিটুজি প্লাস পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশি শ্রমশক্তি রফতানির বৃহত্তম বাজার হিসেবে সৌদি আরবের শ্রমবাজার আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মধ্যপ্রাচ্যে জিসিসিভুক্ত অন্য দেশগুলোও সৌদি নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশি শ্রমিকদের আকামা, ভিসা জটিলতাসহ যে নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল তা না থাকলে বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি আরো অনেক ওপরে থাকত। দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সৌদি শ্রমবাজারের দুয়ার আবার উন্মুক্ত হলেও তা যথাযথভাবে কাজে লাগানোর পর্যাপ্ত ও উদ্যোগ বা গাইডলাইন দেখা যাচ্ছে না। বিশেষত জিটুজি ব্যবস্থাপনায় স্বল্পব্যয়ে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগে যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল তার বাস্তব প্রতিফলন একেবারেই অনুপস্থিত। সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ও একই অবস্থা বিরাজমান রয়েছে। যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে এর আগে সৌদি শ্রমবাজারে আমাদের শ্রমিকদের জন্য অচলাবস্থা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছিল শর্তসাপেক্ষে তা উত্তরণে দুই দেশের সরকার একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে সক্ষম হলেও শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণের মধ্য দিয়ে বৃহত্তম শ্রমবাজারকে আবার ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর শ্রমিকদের নানা ধরনের সংক্রামক ও ভাইরাল রোগ ধরার পড়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর ফলে বাংলাদেশে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, একইভাবে শ্রমিক পাঠাতে সংশ্লিষ্ট দফতরে তদারকি ব্যবস্থা নিয়েও সৌদি আরবসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে এক ধরনের বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি হওয়ায় এমনিতেই অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান খুব সীমিত হয়ে পড়েছে। বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চাপ বেড়ে চলেছে। এহেন বাস্তবতায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ কাজে লাগিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত রাখাই এই মুহূর্তে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। প্রায় এক দশকের ঘোষিত-অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজার যখন আবারও সম্ভাবনাময় ও সরগরম হয়ে উঠেছে তখন এক শ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির দুই নম্বরি কর্মকা-ের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে নতুন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদেশগামী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু মেডিক্যাল সেন্টার রয়েছে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের জন্য গামকা নামে পরিচিত মেডিক্যাল সেন্টারগুলো থেকে সার্টিফিকেট নিতে হয়। গামকা মেডিক্যাল সেন্টারগুলো থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট লাভের ক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানি, সিন্ডিকেটেড ঘুষবাণিজ্য ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। সম্ভবত এসব কারণেই এক শ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সি গামকার বদলে অননুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টার বা ভুয়া ফিটনেস সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কূটনৈতিক উদ্যোগে সৌদি শ্রমবাজার আবার উন্মুক্ত হওয়ার পর গত বছর সর্বোচ্চসংখ্যক, সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব গেছেন।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এসব শ্রমিকের বিশাল অংশই গামকার মেডিক্যাল ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই সৌদি আরব গেছেন। যথাযথ পরীক্ষা ও অনুমোদিত ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই লাখ লাখ শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার পর এদের মধ্যে হাজার হাজার শ্রমিকের নানাবিধ স্বাস্থ্য জটিলতা ধরা পড়ছে। অতীতে যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশি শ্রমিকরা সৌদি আরবসহ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোয় অনাকাক্সিক্ষত নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছিল সেসব বিষয় পুরোপুরি একপক্ষীয় ছিল না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগ ও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের শ্রমিকদের কেউ। এখন যে গামকার সার্টিফিকেটহীন ব্যক্তিদের ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে তাতে যেমন এক শ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সির হাত রয়েছে, তেমনি সৌদি দূতাবাস ও বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তার গাফিলতি ও যোগসাজশেরও অভিযোগ রয়েছে। সন্দেহ নেই, ঘুষ-দুর্নীতি বাংলাদেশে অন্যতম সামাজিক-প্রশাসনিক সমস্যা। কিন্তু সৌদি আরবেও যে অর্থনৈতিক খাতে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা সাম্প্রতিক সময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবে, আরব আমিরাতে বা মালয়েশিয়ায় যাই ঘটুক, আমাদের শ্রমবাজার তথা বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাবনা অক্ষুণœ রাখতে বৈদেশিক শ্রমবাজার-সংক্রান্ত প্রতিটি ধাপ ও খাতকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও গতিশীল রাখতে হবে। অননুমোদিত মেডিক্যাল সেন্টারের ভুয়া মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশগামী শ্রমিকদের দুরারোগ্য, সংক্রামক ব্যাধি ধরা পড়লে সৌদি বা জিসিসিভুক্ত দেশগুলোয় আবারও নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তা বিদেশে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা ও অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

কোনো একটি দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হলে তার প্রভাব অন্যান্য দেশেও পড়বে। এতে অর্থনীতির প্রধান খাত জনশক্তি রফতানি ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে। কোনো দুর্নীতিবাজ রিক্রুটিং এজেন্ট বা দূতাবাসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হওয়ার আগেই এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। গামকার অবকাঠামো ও জনশক্তি কাজে লাগানোর উদ্যোগের পাশাপাশি সব ধরনের দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা দূর করার বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জনশক্তি অধিদফতর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিষয়টি অবশ্যই উদ্বেগের। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস। শ্রমিকরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়েই গড়ে তোলেন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ রিজার্ভ। এ কারণে আগামীতে শুধু অদক্ষ শ্রমিক না পাঠিয়ে দক্ষ শ্রমিকসহ অন্যান্য পেশাজীবী পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে কর্মের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের বিদেশি ভাষাজ্ঞান ও পেশাগত কাজের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাহলে বিদেশে তাদের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা বাড়বে। দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর নিত্যনতুন বাজার সৃষ্টি করতে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করাও জরুরি। তবে বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের বহুমুখী সমস্যার সমাধানসহ তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে তৎপর না হলে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হতে থাকবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist