ফয়জুন্নেসা মণি

  ২০ জানুয়ারি, ২০১৮

শিক্ষাসেবা

যেজন জ্বালিছে মোমের প্রদীপ

আবদুল মালেক হাওলাদার। বয়স ৯০ বছর। তিনি একজন প্রচারবিমুখ শিক্ষাগুরু। মাদারীপুর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের মিঠাপুর গ্রামের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক তিনি। নিজের একান্ত আগ্রহের জোরে ৬৫ বছর ধরে নিভৃতে নিরলসভাবে এলাকার মানুষের শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন । আবদুল মালেক এলাকার মানুষের শিক্ষার কথা চিন্তা করে ১৯৪২ সালে চার-পাঁচজন ঝরে পড়া, অমনোযোগী শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা করেন তার পাঠশালার। এলাকার শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তার এ মহান উদ্যোগ। আত্মনিবেদিত এই মহান শিক্ষানুরাগীর পরম মমতায় গড়ে ওঠা ব্যতিক্রম এই বিদ্যাপীঠ স্বনামেই প্রতিষ্ঠিত। মালেকের পাঠশালা। এলাকার অভিভাবকরা তাদের অমনোযোগী সন্তানদের শিক্ষাগ্রহণের জন্য তুলে দেন এই শিক্ষাগুরুর কাছে। নিজস্ব পদ্ধতিতে শিক্ষার আলোতে তিনি তার শিক্ষার্থীকে আলোকিত জীবনের পথ দেখিয়ে চলেছেন। আবদুল মালেকের পাঠশালায় প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নাচ, গান, খেলাধুলা, অভিনয়সহ সব ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন তিনি। নিভৃতচারী এই শিক্ষাগুরু একটা জীবন কাটিয়েই দিলেন এলাকার শিশুদের শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করে তুলতে। বাস্তবেও হয়েছে তাই। আবদুল মালেকের পাঠশালা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে ৬৫ বছরে অসংখ্য শিক্ষার্থী পেয়েছেন জীবনের দিশা। মেধা ও যোগ্যতায় তার ছাত্রদের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং কেউ কেউ সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এ ছাড়া অনেকেই নিজ নিজ পেশায় ব্যবসা-বাণিজ্যে জীবনকে করেছেন আলোকিত। আমরা এই উদার আদর্শবান ব্যক্তিত্বের প্রতি অবনত শ্রদ্ধা জানাই। ৯০ বছর বয়সের ভারে যে ব্যক্তিটি এখনো নিজের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছেন তার যেন ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা হয়। আবদুল মালেকের কাছে হাতেখড়ি পাওয়া প্রতিষ্ঠিত শিক্ষার্থীরা মিলে তার স্বপ্নের ¯্রােতধারা বহমান রাখবেনÑএটাই আমাদের প্রত্যাশা।

একটি গল্প জন্ম দেয় এক জাগরণের। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ হোসেনের জীবনেও ঘটেছে ঠিক এমনটিই। আর্থিক অসচ্ছলতা আর অভিভাবকের অসচেতনতার কারণে এক দিন পিতার নির্দেশে তাকে ধরতে হয় লাঙলের হাল। কিন্তু হলে কী হবে, পড়াশোনার অদম্য উৎসাহ ঠিকই তাকে ছাড়িয়ে নিয়েছে অন্ধকার থেকে আলোর পথে। সেই মোহাম্মদ হোসেন এক দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরের গ্রামে গিয়ে জায়গীর থেকে পড়াশোনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ৩৬ বছর শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন তিনি। অবসর নিয়ে যখন নিজ গ্রামে ফিরে এলেন; তখন দেখলেন তার গ্রামে এখনো তার বাবার মতো অসচেতন অভিভাবক রয়ে গেছেন; যার ফলে অনেক সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোর বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে। এ অবস্থা দেখে জেগে উঠল শিক্ষকের বিবেক। নিজ বাড়িতেই তিনি খুলে দিলেন বিনা পয়সার পাঠশালা। দাদুর পাঠশালা হিসেবে তার বিদ্যালয়ের সুখ্যাতি এখন সারা উপজেলায়। এ যেন এক অন্যরকম বিদ্যাপীঠ। সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত প্রায় ৮০ জন দরিদ্র পরিবারের সদস্য শিক্ষা নিতে আসে পাঠশালায়। মোহাম্মদ হোসেনের এই পাঠশালায় চেয়ার, বেঞ্চ, ব্ল্যাকবোর্ড কিছুই নেই। মাটিতে মাদুর পেতেই পড়ছে এতগুলো সম্ভাবনাময় শিশু। রুটিনমাফিক মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে গ্রামের আরেক তরুণী সকাল ৮টা পর্যন্ত বিনা পারিশ্রমিকে পড়া শেখান শিক্ষার্থীদের। শুধু তাই নয়, মোহাম্মদ হোসেন তার অবসর ভাতার টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের কিনে দেন শিক্ষা উপকরণসহ পড়াশোনার সহায়ক বিষয় ও জিনিস। স্কুল ছুটির আগে নিয়ম করে ছাত্রছাত্রীদের নাচ, গান শেখান তিনি। শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনতা এবং যৌতুক প্রথার কুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিই তার গানের মূল বিষয়বস্তু। ব্যতিক্রম এই বিদ্যাপীঠের দুই শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন ও নয়নতারা নানা-নাতির সম্পর্কে আবদ্ধ। তাই এলাকাবাসীর কাছে এই বিদ্যাপীঠটি নানা-নাতির পাঠশালা হিসেবেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

দাদুর পাঠশালায় হাতেখড়ি নিতে ভোরবেলা থেকেই দলবেঁধে আসে শিক্ষার্থীরা। অভাবে ক্লিষ্ট কৃষক, দিনমজুর ও নানা পেশায় খেটে খাওয়া মানুষের ছেলেমেয়েরা এখন পড়ছে। এ আনন্দই যেন মোহাম্মদ হোসেন আর নয়নতারার পরম প্রাপ্তি। তাদের পাঠশালা থেকে হাতেখড়ি নিয়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে পাশের কাশিয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রবীণ শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেনের শিক্ষানুরাগের প্রতি এলাকার মানুষের রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। উপজেলা শিক্ষা কমিটি ২০০৪, ০৫ ও ০৬ সালে তারাগঞ্জ উপজেলার ৭১টি সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতিদের মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ সভাপতি নির্বাচন করা হয়। মহান এই নিবেদিত শিক্ষক নিজের স্কুল ছুটির পর অন্য স্কুলে গিয়ে খোঁজখবর ও তদারকি করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন। মানুষকে শিক্ষাসচেতন এবং শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা আমাদের জন্য অনুসরণীয় হোক।

এবার জানা যাক কানাই মাস্টারের গল্প। পল্লী চিকিৎসক কানাই ডাক্তার এখন কানাই মাস্টার নামেই অধিক পরিচিত। ৫২ বছর বয়সী পল্লী চিকিৎসক কানাইলাল দাস বাস করেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের দুয়েকজন প্রান্তিক চাষি ছাড়া ৭৫টি পরিবারের সবাই ক্ষেতমজুর। সুবিধাবঞ্চিত এ গ্রামে কোনো পায়খানা নেই। তাই অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। বিশেষ জটিলতা ছাড়া কানাই ডাক্তারই তাদের ভরসাস্থল। বরেন্দ্র ভূমির উঁচুনিচু পথ ধরে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কানাই ডাক্তার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। আর অসুস্থ রোগীর সন্ধান পেলেই চিকিৎসা সহায়তার জন্য ছুটে যান তিনি। দীর্ঘ পথ চলতে গাছের ছায়ায় ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম নিতে হয় তাকে। এ সুবাদে গ্রামের চঞ্চল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নানা গল্প জমে তার। এ যেন নিত্যদিনের ঘটনা। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তিনি গ্রামের মানুষের হালহকিকতের খবর নেন শিশু-কিশোরদের কাছে। তাদের নিয়েই তিনি ছুটে যান এবাড়ি-ওবাড়ি। সাইকেলে চড়ে চলছেন কানাই ডাক্তার আর তার পিছু পিছু ছুটছে শিশুদের দল। শিশুদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানলেন গ্রামের ২০০ শিশুর মধ্যে মাত্র একজন পড়তে যায়। উপস্থিত শিশুদের কেউ কেউ কানাইলাল ডাক্তারকে তাদের পড়ানোর জন্য আকুতি জানায়। পড়াশোনার প্রতি শিশুদের আগ্রহে নতুনভাবে জেগে ওঠেন কানাইলাল। যেই ভাবনা, সেই কাজ। পাড়ার শিশুদের নিয়ে গ্রামেই খুঁজে পেলেন বেড়াবিহীন এক চালাঘর। সেখানেই খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে শুরু হয় পল্লী ডাক্তার কানাইবাবুর ‘কানাই ডাক্তারের পাঠশালা’।

বিনা পারিশ্রমিকে শিশুদের পড়াশোনার অদম্য উৎসাহকে আরো মাতিয়ে দিলেন তিনি। তারপর তিনি নিজের পয়সায় স্লেট, পেনসিল কিনে পাঠদান শুরু করলেন। এভাবেই সপ্তাহে তিন-চার দিন দু-তিন ঘণ্টা করে চলে কানাইবাবুর পাঠশালা। চলছিল বেশ। এক দিন হঠাৎ গ্রামের এক অভিভাবক সামান্য খেসারির ডাল আর গম নিয়ে হাজির হলেন পাঠশালায়। কানাইবাবুকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘কয়েক বাড়ি চেয়ে নিয়ে এসেছি। গুরুকে দক্ষিণা না দিলে কি চলে? আমরা গরিব আদিবাসী, না নিলে মনে কষ্ট পাব।’ অভিভাবকের কথায় কানাইলালের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। তিনি অভিভাবকদের ডেকে বলেন, ‘আমাকে কিছু দিতে হবে না। আপনারা চাঁদা তুলে পাঠশালার জন্য একটা ঘর করে দেন, এতেই হবে।’ কানাইলাল এভাবেই স্বঃপ্রণোদিত হয়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে শিশুদের শিখিয়ে যাচ্ছেন আলোর পথের দিশা। বাড়ছে তার আরো শিক্ষার্থী। কানাইবাবুর এই আত্মনিবেদনকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। সমাজকে আলোকিত করতে তার মতো স্বার্থত্যাগী মানুষের বড়ই প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষক, কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist