বিশ্বজিত রায়

  ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮

নিবন্ধ

সত্য বললেন নওয়াজ শরিফ

একটি ছোট্ট সংবাদ আমার দৃষ্টি কেড়েছে। ‘আমরাই বাংলাদেশকে আলাদা করেছি’ শিরোনামের সংবাদটি ছোট হলেও এর ভেতরগত বর্ণনা ছিল প্রশংসাযোগ্য। ওই সংবাদ শিরোনামের এই বাক্যটুকু বলেছেন পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তিনি পাকিস্তান কর্তৃক অতীতের অনেক ভুলভ্রান্তি, অবিচার সুলভ আচরণ ও জোরজবরদস্তির সমালোচনা করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। অনেক পরে হলেও প্রকৃত সত্য স্বীকার করে তিনি অনুতপ্ত।

পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী সাধু-বৈষ্ণবের মতো পরাজিত পাকিস্তানকে হুশিয়ার করে প্রকৃত সত্যের অনুসারী বনে গেছেন। তিনি কী বলেছেন তা জানতে হলে একটু সংবাদ ভাষ্যে যেতে হবে। খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানে একের পর এক গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রসঙ্গ তুলে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেছেন, ১৯৭১ সালে তাদের কারণেই বাংলাদেশ আলাদা হয়েছিল। গতকাল (৯ জানুয়ারি) ইসলামাবাদে পাঞ্জাব হাউসে একদল আইনজীবীর সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় পাওয়ার পরও তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা ছাড়েনি। উল্টো নানা টালবাহানার পর বাঙালির ওপর চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ, যার পরিণতিতে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই প্রসঙ্গ তুলে নওয়াজ বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী ছিলেন না। কিন্তু আমরা তাকে বিদ্রোহী করেছিলাম। পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালির কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমরা ভালো আচরণ করিনি এবং আমাদের থেকে আলাদা করেছি।’ অন্য এক প্রসঙ্গে নওয়াজ বলেন, ‘বিচারপতি হামদুর রহমান কমিশন বাংলাদেশের সৃষ্টি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণপূর্বক খুবই সত্য ও স্পষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আমরা তা পড়েও দেখিনি। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা যদি পদক্ষেপ নিতাম তাহলে আজকের পাকিস্তান ভিন্ন হতো এবং যে ধরনের খেলা হয়ে থাকে সেগুলো হতো না।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে পাকিস্তান সরকার গঠিত হামদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনে একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে দায়ী করে তাদের বিচারের সুপারিশ করা হয় (বিডিনিউজ)। নওয়াজ শরীফের এই বাক্যবাণে প্রমাণিত হয়, পাকিস্তান এখনো শিক্ষা নিতে পারেনি।

বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার ৪৬টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। একাত্তরের ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দ্বিখ-িত দুই দেশের মধ্যে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন লক্ষণীয়। কোথায় ভুট্টো-ইয়াহিয়ার পাকিস্তান আর কোথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশ। আজ দুটি দেশ দুদিকে অবস্থান করছে। একটি ভঙ্গুর ব্যর্থ জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এবং অন্যটির উন্নয়নমুখী সফলতা ও সমৃদ্ধিশালী রংরূপ বিশ্বের স্বচ্ছ আয়নায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। এদিকে পাপের বোঝা মাথায় অভিশপ্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে কোনো ধরনের টিকে আছে। অন্যদিকে তার বিপরীতে অবস্থানকারী বাংলাদেশ উন্নয়ন অগ্রগতির রোল মডেল হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যেখানে শুভ, সুন্দর ও সফলতার রাজপথে জোরকদমে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে পাকিস্তান পাল্লা দিয়ে হাঁটছে পেছনের পথে। শুধু পেছনেই নয়, সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া এ রাষ্ট্রটি নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে বিশ্ব বিবেচনায় বর্জিত জাতি হিসেবে শূন্যের কোঠায় অবস্থান করছে। পাপিষ্ঠ পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ধিকৃত বিষয়াদি অস্বীকার করে ধ্রুব সত্যকে যেমন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে, তেমনি বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলার সব ষড়যন্ত্র চক্রান্তে গা ভাসিয়ে ওপরে ওঠার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পাকিস্তান এখনো বুঝে উঠতে পারছে না, সত্য কত কঠিন। সত্য সত্যের মতোন করে প্রতিশোধ নেয়।

পাক-পরাজয় ও বাংলা বিজয়ের মীমাংসিত বিষয়গুলো ইতিহাস নিজের করে নিয়েছে পরম যতনে। একমাত্র ইতিহাসই চরম সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরতে সক্ষম। ইতিহাস কারো চোখ রাঙানির পরোয়া করে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো আজকের একঘরে পাকিস্তান ও পাকপ্রেমি এ দেশীয় দোসররা ইতিহাসের পাতায় বর্ণিত আসল সত্যটাকে ক্ষমতার শক্তিশালী রাবার দিয়ে মুছে ফেলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বারবার। কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু হবে বা হচ্ছে, সেটা অনুমান করতে পারছে না বোকা বুধুমিয়া পাকিস্তান। একাত্তরের অমার্জনীয় অপরাধ এবং পাক-বাংলা বিভক্তির স্বৈরাচারী জুলুমবাজিতা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে কখনো মাথা নত করেনি। বরং অন্যায়-অবিচারের পক্ষে সাফাই গেয়েছে বারবার। তবে রাষ্ট্র পাকিস্তানের যখন পল্লীপ্রবাদ ‘চোরের মার বড় গলা’ অবস্থা তখন প্রাক্তন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ হয়তো সত্যের সুতায় টান দিয়ে নিজেকে একটু পাপমুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

ক্ষমতাহীন যন্ত্রণায় কাতর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ মনে হয় নিজের দুঃখ ভুলতে ইতিহাসের চরম সত্য কথাগুলোই বলে দিয়েছেন। জানি না, নওয়াজের এই বাক্যবাণ তাকে পাকিস্তানে বসবাস অনুপযোগী করে তুলবে কি না। কারণ এমনিতেই দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, এর মধ্যে সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যদি আরো কঠিন শাস্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় তাহলে সেটা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হবে বৈকি। এত দিন পরে হলেও একজন আপাদমস্তক পাকিস্তানি, এও আবার তিনবারের নির্বাচিত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ শতভাগ সঠিক সত্যে সুর মিলিয়েছেন, এর জন্য একজন বাঙালি হিসেবে তাকে ধন্যবাদ জানাই। অন্তত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিহাসের নিষ্পত্তি করা কিছু সত্য বিষয় পাকিস্তানিদের সামনে তুলে ধরেছেন। এতে মানবতাবাদী মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।

পাকিস্তান। জঙ্গিবাদে জংধরা একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের নাম। যে দেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মানুষ। রাষ্ট্রগতভাবেও অনেকের রয়েছে বিধিনিষেধ। কিন্তু একাত্তরে পৃথক হওয়া বাংলাদেশের নেই সে অবস্থা। বিশ্ববাসী পাকিস্তান থেকে আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার উল্টো। যারা একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি অপবাদ দিয়ে তৃপ্ত হয়েছিল তারাই আজ বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

একাত্তরে বাঙালিদের ওপর চালানো অকথ্য নির্যাতন, নির্মম অত্যাচার আজও পৃথিবী ভুলেনি। কিন্তু পাপিষ্ঠ পাকিস্তান বেমালুম ভুলে গেছে। শুধু ভুলে গেছে তা-ই নয়, তারা এখনো বাংলাদেশকে ঘায়েল করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ দেশের ইতিহাস বিকৃতকারী ও একাত্তরের পাকিস্তানি দোসরদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একাত্তরের ঘাতক পরাজিত শক্তি নির্লজ্জ পাকিস্তান। গত বছরের অক্টোবরে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের ‘পাকিস্তান অ্যাফেয়ার্স’ নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে ১৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়, যেখানে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান নন, জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। আর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দীন আহমদ এ ব্যাপারে তখনকার মেজর জিয়াকে সমর্থন দেন।’ ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন গত ২৬ অক্টোবর তাদের ফেসবুক পেজে ওই ভিডিও শেয়ার করলে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে খবর আসে। পরে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলে হাইকমিশনের ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি সরিয়ে ফেলে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যে পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সর্বদা লম্ফজম্ফ করে যাচ্ছে সেই নীতিভ্রষ্ট পাকিস্তানের একসময়কার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সম্পূর্ণ উল্টো সুরে কথা বলছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানই সত্য এবং সঠিক ছিল বলে একশোতে একশো মার্ক দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালীন এই পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী কখনো সে কথা স্বীকার করেননি।

সর্বশেষে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সম্পাদকীয় স্তম্ভের আংশিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। ‘আমরা জানি না, বর্তমান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা শুনবেন কিনা। দীর্ঘদিনের দাবি এবং ইতিহাসের ন্যায়সংগত নিষ্পত্তি তারা করবে কিনা। তবে বিবেকবান মানুষ বোঝেন যে, একমাত্র এ পথেই পাকিস্তান একাত্তরের একটি মর্যাদাপূর্ণ সমাধান করতে পারে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে তোলার পথ সুগম করবে। আমরা অবশ্যই চাইব একাত্তরে যারা গণহত্যা, সম্পদ বিনষ্ট করা এবং নারীর প্রতি সহিংসতার মতো জঘন্য অপরাধ করেছিল তাদের বিচার হবে। নওয়াজ শরিফ যদি সে পথ সুগম করতে পারেন তবে ইতিহাসে তিনি ঠাঁই পাবেন। পাকিস্তানও সুবিবেচনার পথে এসে তার বর্তমান অস্তিত্বের সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।’

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist