শামীম শিকদার

  ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮

অধিকার

কেন এই বর্বরতা

শিশু অধিকার সনদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে যারা রয়েছে তারা সবাই শিশু। বর্তমান পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৮ ভাগই এই দলে। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন ও গ্রহণ করে। সাধারণ পরিষদের সভায় উপস্থিত ১৭৮ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান সনদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৯০ সালের ২৬ জানুয়ারি সনদের মূল দলিলটি সদস্য রাষ্ট্রসমূহের স্বাক্ষর, অনুসমর্থন ও জাতিসংঘের নীতিমালার অন্তর্ভুক্তির জন্য উন্মুক্ত করা হয়। প্রথম দিনেই যেসব রাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর দান করে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ এই সনদে অনুসমর্থন দেয় অর্থাৎ সনদের বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার গ্রহণ করে। শিশু সনদের অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ(ক). বেঁচে থাকার অধিকার (স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ)। (খ). বিকাশের অধিকার (উপযুক্ত জীবনযাত্রার মান ভোগের অধিকার, অবকাশযাপন, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ)। (গ). সুরক্ষার অধিকার (শরণার্থী শিশু, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশু, শোষণ, নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন শিশু)।

এসব অধিকার তো দূরের কথা শিশুরা আজ শিকার হচ্ছে নানা ধরনের নির্যাতনের। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট ৩৮ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনোভাবে শ্রমে যুক্ত। মোট শিশুশ্রমিকের ৫৭ শতাংশ মারধর এবং ৪৬ শতাংশ গালিগালাজের শিকার হয়। আবার যেসব শিশু গৃহকর্মীর কাজ করছে, তাদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ মানসিক নির্যাতন এবং ৭ শতাংশ ধর্ষণের শিকার হয়। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় মালিকরা মাত্রাতিরিক্ত চাপে রাখে শিশুশ্রমিকদের। ফলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আবার কোনো না কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিপজ্জনক কাজে বাড়ছেই শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। বিপজ্জনক কাজ বলতে বোঝায় ঝালাই কাজ, পাথর ভাঙা, কুলির কাজ, ভ্যানগাড়ি চালানো, যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার, বিড়ি ও ব্যাটারি ফ্যাক্টরিসহ রাসায়নিক-সংক্রান্ত কারখানায় কাজ। এসব কাজে না আছে নির্দিষ্ট সময়, না আছে উপযুক্ত কোনো মজুরি।

শিশুদের সুন্দর হাসি দেখে মন ভরে না এমন মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে। শিশুদের মায়াবী চোখের নিষ্পাপ চাহনিতে নিমিষেই মা-বাবার দুঃখ কেটে যায়। পৃথিবীর প্রত্যেক মা-বাবা চান তার সন্তানকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে লালনপালন করতে। প্রত্যেক মা-বাবার বুকে তার সন্তানকে নিয়ে লালিত থাকে হাজারো স্বপ্ন। শিশুরা আগামী দিনের কর্ণধার, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামী দিনের প্রজন্মকে পরিচালনা করবে তারাই। আর সে শিশুরা যদি থাকে অবহেলিত, ক্লান্ত তাহলে চলবে কী করে আগামী প্রজন্ম। দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে অনেক কঠিন কাজে। দারিদ্র্র্যের করাল গ্রাসে তলিয়ে যাচ্ছে কচিকাঁচাদের জীবন। যে বয়সে খাতা-কলমভর্তি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা, সে বয়সে লিপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কঠিন কাজে। ইচ্ছার বাইরেও তাদের কাজ করতে হচ্ছে। শুধু কাজ করেই ক্ষান্ত নয়, শিকার হচ্ছে নানা ধরনের নির্যাতনেরও। পথেঘাটে চলার সময় আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাই এ ধরনের চিত্র।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৩৫৮৯টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল; যাদের মধ্যে ১৪৪১ শিশু অপমৃত্যু এবং ৬৮৬ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ২০১৭ সালে ৩৮৪৫ শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৭১০ শিশুর অপমৃত্যু ও ৮৯৪ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ‘স্টেট অব চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশে’র এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে মোট ৫৯৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে; যাদের মধ্যে ৭০টি দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ৪৪টি প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৭টি শিশু অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়াও ৭২টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ৫১টি শিশু ইভটিজিং ও ৯০টি শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে; যাদের মধ্যে ২৫টি শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছে। বখাটের হাতে লাঞ্ছনা, মারধর এমনকি হামলা, জখম হয়েছে ৬২ মেয়েশিশু এবং প্রতিবাদ বা প্রতিহত করতে গিয়ে বখাটেদের হামলায় আহত হয়েছে ৫০ অধিক অভিভাবক। শিশু হত্যা ও ধর্ষণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭তে যথাক্রমে ২৮ শতাংশ এবং ৩৩ শতাংশ বেশি। সেই সঙ্গে বেড়েছে দলবদ্ধ ধর্ষণ, প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণ, বখাটেদের মারধরে কুপিয়ে জখম এবং গোপনে অশ্লীল ভিডিও ধারণের প্রবণতা।

এমন অবস্থায় আজ বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও কোনোভাবে নিরাপদ নয়, তা বলতে কোনো সন্দেহ নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে হলেও শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা বন্ধ করা প্রয়োজন। তার জন্য সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণকেও সচেতন হতে হবে। তাছাড়া যেহেতু দেশের একটি বৃহৎ অংশ শিশু, তাই শিশুদের জন্য একটি অধিদফতর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে এবং যা সময়ের অন্যতম প্রধান এক দাবি।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist