রবিউল ইসলাম, টঙ্গী (গাজীপুর)

  ০৮ মার্চ, ২০২৪

বঞ্চনা আর যৌনদাসীর জীবন

দিনের আলো নিভে রাত নেমেছে। অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশ। ছুটে চলা গাড়ির হর্ন আর রেলের ঝিকঝিক ছন্দে গন্তব্যে যাচ্ছেন ক্লান্ত মানুষ। শুধু ক্লান্তি নেই এক অন্ধকার জগতের নারীদের। এখানে রাতই তাদের টাকা রোজগারের সময়। হাজারো দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে তারা রাস্তায় নামের টাকার বিনিময়ে দেহ বিলানোর জন্য। তারা রূপের পসরা সাজিয়েছেন সস্তা মেকাপের সাজুগোজুতে। প্রেমহীন এই শরীরী বিনোদনের দুনিয়ায় তারা সবাই সমাজচ্যুত বাসিন্দা। এই জগতের বাসিন্দাদের নেই কোনো ভেদাভেদ। তারা টাকার বিনিময়ে নতুন নতুন বাসর সাজান। সেবা দেন যৌন বিনোদনের। সমাজ যাদের গায়ে ছাপ মেরেছে পতিতা বলে। আটকে রেখেছে যৌনদাসীর অসহনীয় জীবনে।

গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকা থেকে বড়বাড়ী মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার পর্যন্ত প্রতিটি ট্রাক, লরি আর নির্জন স্থানগুলোতে বসে আসর। এসব আসরে থাকে একাধিক নারী। তাদের প্রধান কাজ পতিতাবৃত্তি করা। রোজ রাতে হাতবদল হওয়া এমনি একজন শামসুন্নাহার (ছদ্মনাম)। একমাত্র ছোট ভাই ভিটেবাড়ি বিক্রি করে ভাগ্য উন্নয়নের জন্য বিদেশ পাড়ি জমায়। কিন্তু তার আর কোনো খোঁজ পায়নি তার পরিবার। বাধ্য হয়েই সংসারের হাল ধরতে হলো মেয়েটিকে। এলাকার এক আপা ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি করত। তার সঙ্গেই গার্মেন্টে চাকরিতে যোগ দেয় শামসুন্নাহার। বছরখানেক পরে ভালো বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে এক দালাল তাকে ধরে এনে বিক্রি করে দেয় রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার পতিতালয়ে। এরপর থেকেই সে অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হয়ে দিন কাটছিল তার। টানা ৭ বছর সেখানে কাটানোর পর তার মনে এক পুরুষ জন্ম দেয় ভালোবাসার। সেই ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে দৌলতদিয়া থেকে টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় আসেন শামসুন্নাহার। ভালোবাসার মানুষ টিকে বিয়ে করে শুরু করে নতুন জীবন। বিয়ে ২ বছর পর জন্ম নেয় প্রথম মেয়েসন্তান।

মেয়ে সন্তানটি বয়স যখন ৫ তখন আবারও সন্তান পেটে আসে শামসুন্নাহারের। পেটের সন্তানের যখন সাড়ে ৪ মাস বয়স তখনই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় শামসুন্নাহারের স্বামী। দুই সন্তানের খরচ বাসাভাড়া সবকিছু জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় শামসুন্নাহারকে। তাই এবার বাধ্য হয়ে নামে সেই আগের অমানবিক পেশায়। তিনি বলেন, প্রথমে দালালের খপ্পরে পরে আসি এই পেশায়। ভালেবাসার মানুষটিকে হারিয়ে নিরুপায় হয়ে আবার এসেছি এই পেশায়। তিনি চরম তিক্ততা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের জীবনের চেয়ে রাস্তার কুকুরদের জীবন অনেক ভালো। আমরা না পারি মাথাউঁচু করে বাঁচতে না পারি নিজের জীবন শেষ করতে।

গত বুধবার রাতে গাজীপুরের মহানগরীর গাছা থানাধীন বড়বাড়ী মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার সামনে পার্কিং করা ট্রাকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ৩৫ বছর বয়সি এক নারীকে। কৌতূহলবসত ওই নারীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি এক কথায় বলেন, কাম করবেন ভাই। কথাটা শুনে বুঝতে আর সময় লাগল না শামসুন্নাহারের মতো তিনিও এই পেশার মানুষ। আগ্রহ নিয়ে তাকে একটু সামনে চায়ের দোকানে চা খাওয়া আমন্ত্রণ জানিয়ে হাঁটতে থাকি। কাজের দরদাম নিয়ে শুরু হয় কথা একপর্যায়ে পারিবারিক খোঁজখবর আর খুঁটিনাটি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তার নাম লাকি (ছদ্মনাম) আনুমানিক ৩৫ বছরের এই নারী ভাষ্য মতে, ‘ছোটবেলায় দেখতাম মায় ঠিকটাক খাওন দিবার পারত না। কারণ আমাগো আব্বায় আমার জন্মের আগেই মইরা গেছে। আমার বড় ভাই একটু আব্বার চেহারা মনে রাখতে পারছে কিন্তু বড় ভাইয়ের ছোটো জন একটুও মনে রাখতে পারে নাই আর আমি তো আব্বারে দেখছি বলে মনে নাই। যখন বুঝ হইলো তখন দেখলাম মায়ের খুব কষ্ট হয় সংসার চালাইতে। বড় ভাই সংসার চালানো জন্য ঢাকায় আসে। এহানে নাকি ভাঙারি টুকাইতো সে। প্রথম প্রথম বড় ভাই বাড়ি ঘরে যাইত কিন্তু ঢাকায় আসার বছর খানিক পর হেও আর বাড়ি যায় না। এদিক দিয়া মায় মরার আগে হের চিকিৎসা জন্য ঘর বন্ধক রাইখা টেকা নিয়া যে চিকিৎসা করাই ছিলাম মেজ ভাই আর আমি সেই টেকাও শোধ করতে পারি না। পরে সবাই মিলা বিচার ডাইকা আমাগো বাসা থেকে বাইর কইরা দিছে। বড় ভাইয়ের খোঁজখবর না পাইয়া আমরা দুই ভাইবোন বাধ্য হয় ঢাকা আইসা পরি। আইসা আমরা কমলাপুর রেলস্টেশনে থাকা শুরু করি আর মাইনশের থেকা এইটা সেইটা চাইয়া খাই। ঢাকা আসার পর আমার বড় ভাইটাও ট্রেনে কইরা কই কই জায় কোন খোঁজখবর থাকে না। এক দিন এক খালায় একজনের বাসায় কাজ নিয়া দিল সেখানে থাকি কাজ করি কিন্তু হেরা অনেক মারতো। সেইখান থেইকা পালায়া আইসা রুম ভাড়া নেই মোহাম্মদপুর বস্তিতে ১ বছরের মতো ওইখানে ছিলাম একটা পোলার সাথে সম্পর্ক হয় ওই পোলা আবার বিয়ার কথা বলে নিয়া যায়, বিয়াও করে। আমি জানতাম না পোলায় নেশাখোর। নেশার টেকার লাইগা ওই পোলা আমারে তার লগের নেশাখোর গো সাথে এই কাজ করতে কইত না করলে অনেক মারতো এমন করতে করতে তার সংসারে ৪ বছর থাকার পর এই কাজটারেই পেশা হিসেবে নিয়া বের হইয়া গেছি, প্রথম প্রথম আবাসিক হোটেল এই কাজ করতাম কিন্তু ওই হানে এহন পুলিশ অনেক ঝামেলা করে তাই এই রাস্তার চিপাচাপায় এই কাজ করি। যারতে জেমন নিবার পারি।’

সুুশীল সমাজের প্রতিনিধি আবুল মাহতাব রনি বলছেন, এ জৎগতের নারীরা দুর্বল আবার কেউ কেউ ক্ষমতাধর। সবচেয়ে খারাপ সময় কাটে যখন প্রথম তারা এখানে প্রবেশ করেন। অনেকেই আসে নারী পাচার চক্রের মাধ্যমে, যাদের বিক্রি করে দেওয়া হয় পতিতালয়ের কোনো এক সর্দারনির কাছে। নতুন আসা বেশির ভাগেরই বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর। পাচার চক্র সর্দারনির কাছ থেকে নেওয়া টাকাটা সর্দারনিকে শোধ করে দেওয়ার আগে তাদের কাজের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। আর বাইরে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই তাদের। সুযোগ নেই খদ্দের বাছাইয়ের। এক কথায় তারা যৌনদাসীতে পরিণত হয়।

গাজীপুর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অসীম বিভাকর বলেন, কোনো মেয়েই খারাপ হয়ে জন্মায় না। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা, পক্ষপাতদুষ্ট সামাজিক নিয়ম, পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব ইত্যাদি পরিস্থিতির স্বীকার হয়েই একটা মেয়েকে বেছে নিতে বাধ্য হয় এই ঘৃণিত জীবন। এটা কোনো মেয়েরই কাম্য জীবন নয়। কোনো মেয়েই স্বেচ্ছায় পতিতার জীবন বেছে নেয় না। সমাজ, সরকার, রাষ্ট্রের দায়িত্ব- এসব নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ও স্বাবলম্বী করে তোলা।

গাজীপুর সমাজসেবা অধিদপ্তরে উপপরিচালক এস এম আনোয়ার করিম বলেন, গাজীপুরে পতিতাদের জন্য তেমন কোনো নির্দিষ্ট জায়গার ব্যবস্থা নেই। তবে আমাদের ৭টি বিভাগে শেল্টার হোম আছে। যখন পতিতাদের আটক করা হয় তখন তাদের সেখানে পাঠানো হয় এবং তারা যাতে সমাজে টিকে থাকার মতো কারিগরি দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, সেজন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close