মো. শাহ আলম, খুলনা

  ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

ডুমুরিয়ায় ৭ নদী অস্তিত্ব সংকটে

অবৈধ দখল আর অপরিকল্পিত খননে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ৭টি নদী- ভদ্রা, সালতা, হরিনদী, শ্রীহরি, শোলমারি, কাজিবাছা ও হামকুড়া এখন অস্তিস্থ সংকটে। এর মধ্যে ভদ্রা ও সালতা নদী অপরিকল্পিত খননে পানিপ্রবাহ সৃষ্টি হয়নি। খননের সময় নদীর জোয়ার ভাটার প্রতিবন্ধকতা (বাঁধ) অপসারণ না করায় খননের মাত্র দেড় বছরের মাথায় নদীটি ভরাট হতে শুরু করে। বর্তমানে দুটি নদীর অধিকাংশ স্থান ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে বিলের চেয়ে নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় এখন বিলের পানি নিষ্কাশনের সুযোগ কমে গেছে। তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৬ কোটি টাকা জলে গেছে।

এদিকে নতুন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা জেলা ও যশোর জেলার ভরাট হওয়া নদনদী খননের জন্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ২০১৮ সালের ৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলনার সার্কিট হাউস মাঠে এক জনসভায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদী খনন কাজের উদ্বোধন করেন, যা পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৯ সালের ৩০ জুন ভদ্রা-সালতা খনন প্রকল্পের মাধ্যমে ভদ্রা নদীর ২১ কিলোমিটার ও সালতা নদীর ৯ কিলোমিটার খনন কাজ শেষ করে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হঠকারী ও অপরিকল্পিত এক সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন সবাইকে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভদ্রা খনন করা হয়, সেটি এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী দুটি খনন করা হয়। ওই সময় উপজেলার খর্ণিয়া ইউনিয়নের গোনালী গ্রাম ও শোভনা ইউনিয়নের গাবতলা এলাকায় একটি রাস্তা (বাঁধ) না কেটে রেখে দেওয়া হয়। ফলে জোয়ারের পানি এসে ওই স্থানে বাধা পেতে থাকে। ফলে আস্তে আস্তে ভরাট হতে থাকে নদী। বাঁধের ওই স্থান থেকে পশ্চিম দিকে ঘ্যাংরাইল নদীর তেলিগাতির উৎপত্তি স্থল থেকে গাবতলা পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার ভরাট হয়। ফলে খননের মাত্র দেড় বছরের মাথায় ১৬ ফুট গভীরতার খনন করা নদীটি গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে আবার দখল করে মাছ চাষ করা হচ্ছে। আবার কোথাও দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি। কেউ কেউ নদীর বুকে শুরু করেছেন চাষাবাস।

ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রা নদী পাড়ের গ্রাম শোভনার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আবদুল করিম খান বলেন, বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা এ ভদ্রা দিয়ে একসময়ে নৌকায় করে কাঁচা তরিতরকারি নিয়ে যেতাম শহরে। এরপর ট্রলারে করেও এ এলাকা থেকে কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে গেছি। সেই নদীটি ১৯৯০ সালের দিকে ভরাট হতে শুরু করে। একসময়ে পুরোপুরি ভরাট হয়ে নদী পথে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভরাট হওয়া নদী পানি উন্নয়ন বোর্ড খনন করে। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে সেটি আবার ভরাট হয়ে গোচারণভূমিতে পরিণত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, শুধু ভদ্রা, সালতা নয়, এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা হরিনদী, শ্রীহরি, শোলমারি, কাজিবাছা, হামকুড়া নদীও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

শোভনা গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ভদ্রা নদীর দক্ষিণের শোভনা গ্রামে সবজি, কুল, পেয়ারাসহ কৃষিপণ্য উৎপাদিত হত। আর এ উৎপাদিত পণ্য এবং এ অঞ্চলের চিংড়ি আনা-নেওয়ার সুবিধায় তখন বাঁধটি কাটা হয়নি। যদিও অধিকাংশ লোক এ বাঁধ কেটে ফেলা দাবি তোলেন। তবে প্রভাবশালী মহলের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। খর্ণিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ দিদারুল ইসলাম বলেন, খননের সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারের অনিয়ম ও আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করার পরিকল্পিতভাবে নদীটি খনন হয়নি। বিধায় আজ আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে।

শোভনা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সরদার আবদুল গণি বলেন, ভদ্রা ও সালতানদী দুটি ডুমুরিয়ার প্রাণ। নদীটি খননের সময় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। প্রভাবশালী অনেকের স্থাপনা রক্ষা করতে গিয়ে আঁকাণ্ডবাঁকা করে খনন করা হয়। তাছাড়া গাবতলায় নদীর মাঝ দিয়ে যাওয়া সড়কটি না কেটে রেখে দেওয়া হয়। এতে ওই স্থানে জোয়ারের পানিতে আসা পলি বাধা পড়ে আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে এখন আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে। ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান গাজী আবদুল হালিম বলেন, ভদ্রা ও সালতা নদী দুটি খননের সময়ে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। প্রভাবশালীদের স্থাপনা রক্ষা করতে গিয়ে আঁকাণ্ডবাঁকা করে খনন করা হয়। যার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান তাজকিয়া জানান, নদী দুটির নাব্য ফিরে পেতে খননের ব্যয় ছাড়াও ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি স্লুইসগেট নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। যদিও পরে তা বাতিল হয়ে যায়। ফলে অতিদ্রুত নদী দুটি প্রায় আগের অবস্থানে ফিরে এসেছে। এজন্য ভদ্রা, সালতা নদীসহ আশপাশের ছোট ছোটনদী-খাল পুনর্খনন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, খুলনাঞ্চলের ভদ্রা, সালতা, হরিনদী, আতাই ভৈরবসহ প্রতিটি নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে খননের প্রয়োজন। এজন্য একটি প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন ও বাস্তবায়িত হলে এলাকাবাসীর জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধান হবে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ভদ্রা ও সালতা নদী খনন করা হয়। একটি বাঁধের কারণে জোয়ারের পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় গাবতলা থেকে ভরাট শুরু হতে থাকে। বর্তমানে তেলিগাতি পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। নদীগুলো খনন করে যদি একটির সঙ্গে অন্যটির সংযোগ স্থাপন করে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া করা যায়। তাহলে নদী খনন সুফল বয়ে আনবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close