রবিউল ইসলাম, টঙ্গী (গাজীপুর)

  ১০ মে, ২০২৪

দখল-দূষণে মরছে তুরাগ

গাজীপুরে টঙ্গীর তুরাগ নদে পানির রং নীল হচ্ছে। আবার লাল পানির দেখা মেলে কিছুক্ষণ পরই। নদের কোনো কোনো স্থানের পানি কুচকুচে কালো কেমিক্যাল মেশানো দুর্গন্ধময় বিষাক্ত। পানির স্রোত নেই বললেই চলে; কোথাও ময়লা-আবর্জনা, পশুর মরদেহ, কচুরিপানার জট। আবার কোথাও নদের জায়গায় বড় বড় দালান আর মিলকারখানা। এভাবেই দূষণ ও দখলে মরে যাচ্ছে এ তুরাগ নদ। কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদকে এখন প্রথম দেখায় ভাগাড় কিংবা বিষাক্ত পানিযুক্ত ড্রেন বলেই মনে হয়।

একসময়ের খরস্রোতা তুরগ এখন দখল আর দূষণের কারণে খাল বা ড্রেনে পরিণত হয়েছে। নতুন প্রজন্মকে কোনোভাবেই বোঝানোর উপায় নেই- একসময়ের কহর দরিয়াখ্যাত ছিল এ নদ। কেউ মানুক না মানুক, শুধু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তুরাগ একটি নদের নাম। জনশ্রুতি আছে- মোগল আমলে ঢাকার শাহ বন্দর ছিল তুরাগ নদের তীরে। পরিবেশবাদীরা মনে করেন, তুরাগ নদসহ দেশের সব নদনদী রক্ষায় যেমন সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি এগিয়ে আসতে হবে শিল্পকারখানার মালিকদের। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে থাকতে হবে নদীর প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ।

তুরাগ নদ গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার প্রবহমান বংশী নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নে এসে দুটি ধারায় বিভাজিত হয়েছে। এর মূল শাখা আমিনবাজার হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়েছে। অন্যদিকে তুরাগের আরেকটি শাখা বিরুলিয়া-আশুলিয়া হয়ে পূর্বদিকে রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা ও উত্তরখান থানা এবং গাজীপুরের টঙ্গী শহরঘেঁষে বালু নদীর সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। নদটির টঙ্গী অংশের এ শাখা তুরাগ নদ হিসেবে পরিচিত হলেও পুঁথি সাহিত্যে সোনাভানের শহর টঙ্গীর কহর দরিয়া নামেও এর পরিচিতি ছিল। কালের বিবর্তনে কোনোরকমে বয়ে যাচ্ছে মৃতপ্রায় তুরাগ নদ।

অন্যদিকে গাজীপুরের কড্ডা ব্রিজ এলাকার কাশিমপুর হয়ে তুরাগের যে মূলধারাটি বিরুলিয়া এলাকায় মিশেছে, সেটির অবস্থাও সংকটাপন্ন। এসব স্থানে নদীগর্ভ কিছুটা চওড়া হলেও পর্যাপ্ত পানি নেই। যেটুকু পানি প্রবাহিত হচ্ছে, সেই পানিটুকু শুধু পানি নয়, কলকারখানায় কালো কেমিক্যাল বাজারের বর্জ্য আর স্থানীয় ড্রেনেজের পানিতে মিশে পুরো নদীর পানিকে যেন এক কেমিক্যালের কুয়ায় পরিণত করেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয় বোর্ডের তথ্যমতে, তুরাগ নদের পানিপ্রবাহের দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার ও গড় প্রস্থ ৮২ মিটার। এ নদের গভীরতা ১৩.৫ মিটার, যার বাস্তবতা এখন নেই বলেই চল।

২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা তিন দিন টঙ্গীর তুরাগ নদ দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। ওইসময় উচ্ছেদে অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালেতের নেতৃত্ব দেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাবিবুর রহমান হাকিম। তুরাগ নদীর দুই পাশে দখল করে গড়ে ওঠা টিনশেড ঘর, বহুতল ভবনসহ ১৩১টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয় ওইসময়। এমনকি উচ্ছেদ করা বালুর গদি নিলাম দিয়ে ৩৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এছাড়া চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১৩ লাখ টাকা নগদ আদায় করা হয়। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ৬ জনকে আটক করা হয়। এ উচ্ছেদ অভিযানে ২ বছরে পর উচ্ছেদের আগের স্বরূপ ফিরে পেয়েছে তুরাগ নদ।

এদিকে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য ও সাংবাদিক কালিমুল্লাহ ইকবাল জানান, এখনই জোরালোভাবে তুরাগ নদ দখল-দস্যুতা থামাতে হবে। নয়তো শহর-বন্দরের ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে যাবে। তিনি আরো বলেন, উচ্ছেদ আর নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করে নদী দখল রোধ করা সম্ভব না। বিআইডব্লিউটিএর উচ্ছেদ অভিযান ঠিকই পরিচালনা করছে, কিন্তু নিয়মিত তদারকি করছে না। বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয়ের ত্রুটি আছে। ফলে বিআইডব্লিউটিএর অভিযানের কিছুদিন পরই ঠিক আগের চিত্রে ফিরে আসছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন গাজীপুর পরিবেশ আন্দলন (গাপা) সাধারণ সম্পাদক মো. মেহেদী হাসান বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা আমাদের দেশের যে প্রচলিত নিয়ম ও আইনের বিধিবিধান আছে, তা মানে না। তারা যত্রতত্র শিল্পকারখানার বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি নদীতে ফেলে নদীদূষণ করছেন। নদীর দূষণ রোধ করতে শিল্প মালিকদের যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি সাধারণ মানুষকেও। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মনে নদীর প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। এর ফলে কমবে নদীদূষণ। নদীমাতৃক এ বাংলাদেশের নদীগুলো আবারও ব্যবহার উপযোগী হবে। টঙ্গীবাজার এলাকার তুরাগ নদের পাড়ে অবস্থীত সিরাজউদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতনের অধ্যক্ষ ওয়াদুদুর রহমান বলেন, নদী দখল রোধে একমাত্র বিকল্প পথ হিসেবে আমরা মনে করছি, নদীর যেসব জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে, জায়গাগুলো উদ্ধার করে ওয়াকওয়ে তৈরি করা এবং নদীর তীরঘেঁষে গাছপালা লাগিয়ে নদী সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা; তাহলেই নদী দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে।

গাজীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া এ বিষয়ে বলেন, গত ৩ বছরে গাজীপুরের বিভিন্ন ডাইং ও ওয়াশিং কারখানাগুলোয় অভিযান পরিচালনা করে ৬ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত। প্রতিনিয়তই পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান চলছে। তবু অসাধু কারখানা মালিকরা অবাধে নদনদী-খাল ধ্বংস করে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তর নদী রক্ষায় বিভিন্ন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’ গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে জানান, ‘নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করছি, অচিরেই এ সমস্যা সমাধান করা হবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close