জাহিদুল হাসান, জবি

  ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪

জীবিকা

ভাগ্যের তালা খুলবে কবে, জানা নেই...

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা

আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন আমাদের চারপাশে বদলে যাওয়া জীবন, তবু কারো কারো জীবন রয়ে গেছে সেই আগের মতোই। প্রযুক্তির প্রয়োগে কঠিন কাজগুলো যেমন সহজ হচ্ছে তেমনি কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের পড়ছে ভাটা। পুরোনো পেশাগুলোর মাঝে তালা-চাবি মেরামতকারীরা অন্যতম। ভুলে হোক কিংবা সজ্ঞানে তালার লক আটকে গেলেই যাদের কদর বাড়ে তারা হলেন এই তালা-চাবির মিস্ত্রিরা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) চার নম্বর গেটের বিপরীতে সব সময়ই দেখা যায় ছোট বক্স নিয়ে কখনো অলস কখনো সামান্য কাজ করে সময় পার করছে মিস্ত্রিরা। কথা হয় তালা-চাবি মিস্ত্রি আবদুল লতিফের সঙ্গে, কথা বলার একপর্যায়ে জানা যায় এই পেশার সঙ্গে তিনি জড়িত ৪০ বছর ধরে। সপ্তাহে ছয় দিন বসেন এই জায়গায়। ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে ও যেকোনো তালা মেরামত করে প্রতিদিন তার আয় হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। আর কোনো কোনো দিন ৫০০ টাকাও আয় হয়। কারো বাসায় গিয়ে কাজ করতে পারলে আয় আরেকটু বেশি হয়। এছাড়া একটি তালা মেরামত করলে ৩০ থেকে ৬০ টাকা ও ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকা মজুরি নেন তিনি। বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী বাজারে এই সামান্য আয় দিয়ে চার সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। তিনি বলেন, একহালি ডিম ৫০ টাকা, এক কেজি আলু ৬০ টাকা এই আয় দিয়ে চলা খুব কষ্ট। তিনি জানান, গাড়ি বাড়ি সব কিছুর তালার কাজে পারদর্শী তিনি। এই কাজ করার জন্য চায়না একটা চাবির মেশিনও কিনেছেন যা দিয়ে কিছুটা সহজেই ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে দেওয়া যায়।

৫০ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত আরেক মিস্ত্রি মোসলেম সারা দিনে মাত্র ৯০ টাকার কাজ করেছেন। তা দিয়ে একবেলা হোটেলে খেলেই শেষ হয়ে যাবে।

এই পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত মোসলেম জানান, এই পেশার সঙ্গে নিজের সন্তানদের আর জড়িত করতে চান না। তিনি জানান, বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে সব তালা-চাবির ধরন বদলেছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট, কি-কার্ডস, কোড সংমিশ্রণ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সব তালা-চাবি ব্যবহৃত হচ্ছে শহরের প্রতিটি বাড়িতে। তাই তো কদর কমেছে এসব এনালগ তালা-চাবির মিস্ত্রিদের। তার ওপর আবার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সব মিলিয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হয় এ পেশার মানুষদের।

আনোয়ার খান নামে এক তালা-চাবি মিস্ত্রির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি। সকাল ১০টায় আসি আর রাত ৮টায় যাই। সপ্তাহে ছয় দিন বসি এখানে। অন্যের তালা মেরামত অথবা ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে সারা দিন সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা আয় করি। কোনো কোনো দিন ১০০ টাকাও আয় হয় না। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত আছি। অন্য কোনো পেশার কাজও করতে পারব না, কারণ অন্য কাজ শিখা হয়নি। তাই এ সামান্য আয়ে জীবন না চললেও পেশাটা ছাড়তে পারছি না।

একই জায়গায় ২৫ বছর এর মতো তালা-চাবি মেরামতের কাজ করছেন মো. আমান। তিনি তার চাচার থেকে শিখে এই কাজ করছেন। তিনি বলেন, এই কাজ করে পরিবার চালানো খুবই কঠিন। কোনো দিন ভালো কোনো দিন খারাপ হয়। তার মতো আরো ৬-৭ জন তালা-চাবির মিস্ত্রি বসেন এখানেই। তাদের মধ্যে কেউ ১০ থেকে ৪০ বছরের ধরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাদের সঙ্গী মোসলেম সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। তাদের সঙ্গেও কথা বলে জানা যায়, একই অবস্থা তাদের। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ছাড়তেও পারছেন না তারা। কিন্তু যা আয় হয় তা দিয়ে বর্তমানে চলাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তারা কেউই তাদের সন্তান অথবা স্বজনদের এই কাজ শেখাতে চান না। কারণ এই পেশার কোনো ভবিষ্যৎ দেখছেন না তারা।

একই জায়গায় আরেকজনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এখন তালার ধরন বদলেছে। সব তালার কাজও আমরা করতে পারি না। এখনকার অনেক মডেলের তালা নষ্ট হয়ে গেলে ফেলে দিতে হয়, মেরামত করা যায় না। আবার অনেক বাড়িতে আধুনিক তালা ব্যবহার করে। তাই আমাদের কদর কমেছে। এ পেশায় এখন আর কোনো ভবিষ্যৎ দেখছি না। তাই এই কাজ সন্তান কিংবা আত্মীয়স্বজন কাউকে শেখাতে চাই না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close