খুলনা ব্যুরো

  ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

বাঘ-বিধবাদের করুণ জীবন

বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য আগের মতো মাঘের সেই ভয়াল শীত নেই, বন উজারে কমে গেছে সুন্দরবনসংলগ্ন জনবসতির আশপাশে বাঘের আনাগোনা। তবে তাই বলে বাঘের শিকারে পরিণত হওয়া মানুষের স্ত্রীদের কপালের দুর্ভোগ কমেনি, তারা করুণ জীবনযাপন করছেন। মাছ, গোলপাতা, মধু বা কাঠ সংগ্রহে সুন্দরবনের ভেতরে গিয়ে বাঘের থাবায় প্রাণ হারানো পুরুষটিকে হারিয়ে এমনিতেই দিশাহারা জীবনযাপন করেন বিধবা নারীরা। তার ওপর আবার যোগ হয়েছে ‘অপয়া’ অপবাদ, স্থানীয়ভাবে তাদের নতুন পরিচিতি হচ্ছে ‘বাঘ বিধবা’। স্বামীদের বাঘের পেটে যাওয়ার পেছনে যেন তারাই দায়ী, এমন ধারণার কারণে গ্রামের অন্যরাও সেভাবে মেশেন না তাদের সঙ্গে। তাই এক ধরনের সমাজচ্যুত জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন এই স্বামী হারানো নারীরা। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে এখন সরকারের হস্তক্ষেপ চাইছেন তারা।

স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই বাঘ বিধবাদের জীবন কাটছে দুর্বিষহ পরিবেশে। স্বামীকে হারিয়ে শিশু সন্তানদের নিয়ে জীবনযুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ডিঙ্গি নৌকায় নদীতে মাছ শিকার বা ঘেরে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের। এভাবে কষ্টকর জীবন-জীবিকার মাধ্যমে নিজেদের শিশু-সন্তানদের বড় করছেন। কিন্তু তাদের কষ্টের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসছে না।

এমনই একজন ভুক্তভোগী নারী রোকেয়া বেগম। তিনি জানান, ২০০৮ সালে তার স্বামী আবদুল গফফার খান সুন্দরবনে যান মাছ শিকারের জন্য। সেখানে গিয়ে পাটাজাল নিয়ে নৌকায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু এ সময় একটি বাঘ এসে তার ঘাড়ের ওপর হামলে পড়ে। এই অবস্থায় তার চিৎকারে অন্যান্য জেলেরা এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু ততক্ষণে বাঘ তার স্বামীর ঘাড়ের ওপর থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নেয়। ফলে শেষ রক্ষা হয়নি। তখন তার সংসারে ছয় বছরের মেয়ে ও সাড়ে তিন বছরের ছেলে। সেই থেকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। নদীতে মাছ ধরে, আর দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন তিনি। স্বামী বাঘের আক্রমণে নিহতের পর কুসংস্কারের প্রভাবে তাদের অলক্ষ্মী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ কারণে তিনি দ্বিতীয় বিয়েও করতে পারেননি।

শুধু রোকেয়া বেগমই নয়। খুলনা, সাতক্ষীরাসহ সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন জেলার গ্রামগুলোতে রয়েছে এমন অনেক দুর্ভাগা নারী।

কয়রার আম্বিয়া খাতুন বলেন, ২২ বছর আগে স্বামী আমজাদ হোসেন সরদার সুন্দরবনে মাছ শিকারে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। এরপরই তিন মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় জীবনযুদ্ধ, যা এখনো চলছে। কিন্তু আমরা খাসজমি বরাদ্দ পাইনি। সরকারি বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা হলেও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। বাঘ বিধবাদের জন্য সরকারের আলাদাভাবে ভাবা প্রয়োজন। স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তিনি। তবে সম্প্রতি এই নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলেপমেন্ট (আইসিডি) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান আশিক জানান, বাঘ বিধবাদের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকে কয়রাতে তিনি কার্যক্রম শুরু করেন। ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সেলাই মেশিন সরবরাহ করেছেন। কয়রা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, বাঘ বিধবাদের তালিকা তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। তালিকা পূর্ণাঙ্গ করার মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. বশির আল মামুন বলেন, বর্তমানে সুন্দরবনে বনজীবী প্রবেশে অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। ফলে বনজীবীরা চাইলেই জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারছেন না। ফলে বনে এখন বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়ার তেমন তথ্যও পাওয়া যায় না। সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বাঘের অবাধ বিচরণ নিশ্চিতকরণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশেও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে বুবার্ট হেনড্রিকস সুন্দরবনে ৩৫০টি বাঘ থাকার তথ্য দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৮২ সালে মার্গারেট স্যালটার নমুনা ও সরেজমিন জরিপ চালিয়ে ৪২৫টি বাঘ থকার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। এর দুই বছর পর রেক্স জিটিন্স সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। সুন্দরবন এলাকায় কাজ করেন এমন লোকজনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য দিয়েছিল বন বিভাগ। পরের বছর সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘের ব্যাপারে তথ্য দিয়েছিলেন। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালের গবেষণায় সুন্দরবনে বাঘ ছিল ৪৪০টি। কিন্তু ২০১৫ সালে ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনা করা হয়। এতে ১০৬টি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে আমেরিকার দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাঘ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্যামেরার সাহায্যে গণনা করেন, যার ফলাফল ২০১৮ সালে প্রকাশ করা হয়। ওই ফলাফলে সুন্দরবনের ১১৪টি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close