আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  ২০ জুন, ২০১৮

মার্কিন শিবিরে বন্দি হাজার হাজার শিশু

বাবাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তারা তার বিন্দুবিসর্গও জানে না। জানে না, মা-বাবার সঙ্গে তাদের আর কোনো দিন দেখা হবে কি না। সব আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে তারা কার্যত একা একাই পড়ে রয়েছে একটি শিবিরে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজার হাজার শিশু, কিশোর। যাদের কেউই একে-অন্যকে চেনে না।

এই শিশুরা মেক্সিকোসহ মধ্য আমেরিকার দেশগুলো থেকে সীমান্ত পেরিয়ে তাদের মা-বাবার হাত ধরে আসতে গিয়েছিল মার্কিন মুলুকে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির ফাঁসে আটকে যায় ওই শিশুদের পরিবার। পরিবার-পরিজন থেকে শিশুদের আলাদা করে নিয়ে তাদের মা- বাবাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় মার্কিন কাস্টমস দফতর। সেই থেকেই শিবিরে কার্যত অনাথ অবস্থায় দিন-রাত কাটাচ্ছে ওই শিশুরা।

এই শিশুদের জীবনযন্ত্রণার কথা এতদিন বাইরে আসেনি, ট্রাম্প প্রশাসন এতদিন প্রচারমাধ্যমের নজর থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল বলে।

শিবিরে ঢুকে গোপনে সেই শিশুদের কথা রেকর্ড করে অলাভজনক সাংবাদিক সংস্থা ‘প্রোপাবলিকা’। সেই গোপন রেকর্ডিং গত সোমবার প্রকাশ পেতেই মার্কিন সীমান্তে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতি নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। যার শরিক হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতাও।

ওই অডিও রেকর্ডিংয়ে শোনা যাচ্ছে, শিশুদের চিৎকার, কান্নাকাটি স্প্যানিশ ভাষায় ‘মাম্মি, মাম্মি’, ‘ড্যাডি, ড্যাডি’ বলে কাঁদতে শোনা যাচ্ছে শিশুদের।

ট্রাম্প প্রশাসনের ওই কঠোর অভিবাসন নীতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে প্রায় আড়াই হাজার শিশু আটক রয়েছে আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর সীমান্ত এলাকাগুলোতে।

‘প্রোপাবলিকা’র প্রকাশ করা অডিও রেকর্ডিংয়ে ৪ থেকে ১০ বছর বয়সী ১০টি শিশুর কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছে। গত সপ্তাহেই সীমান্ত পেরিয়ে আমেরিকায় ঢোকার সময় যাদের মা-বাবাদের গ্রেফতার করা হয়। আর মা-বাবার থেকে ওই শিশুদের আলাদা করে নিয়ে অন্য একটি জায়গায় আটকে রাখা হয়।

শিবিরে শিশুদের সেই কান্নাকাটি শুনে এক সীমান্তরক্ষী বলেছেন, ‘যেন অর্কেস্টা হচ্ছে। শুধু সেই অর্কেস্ট্রার কোনো পরিচালক নেই।’

এল সালভাদরের একটি ছয় বছরের মেয়েকে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘যাওয়ার সময় মা বলে গিয়েছিল পিসি এসে আমাকে নিয়ে যাবে। পিসি আসবে কবে?’

গোপনে রেকর্ড করা ‘প্রোপাবলিকা’র সেই অডিও সংবাদমাধ্যমের হাতে এল কীভাবে?

খবরটি যিনি প্রথম করেছিলেন, সেই পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী সাংবাদিক, দৈনিক ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর মেক্সিকো সিটির পূর্বতন চিফ অফ ব্যুরো জিঙ্গার থম্পসন জানিয়েছেন, মানবাধিকার রক্ষা সংক্রান্ত বিশিষ্ট আইনজীবী জেনিফার হারবারি তাকে ওই অডিও রেকর্ডিং দিয়েছেন।

আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিওরিটি দফতর অবশ্য ওই অডিও সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি।

ট্রাম্পের অভিবাসন নীতিকে সরকার অনুমোদিত শিশু নির্যাতন বলেছে জাতিসংঘ : যুক্তরাষ্ট্রে অনথিভুক্ত অভিবাসী শিশুদের তাদের মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করার কঠোরনীতির সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশন। ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত এ ধরনের পদক্ষেপকে ‘সরকার অনুমোদিত শিশু নির্যাতন’ আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন জেইদ রাদ আল হুসেইন। চলতি মাসে আগেও একবার মানবাধিকার কমিশন থেকে এ নীতির নিন্দা জানানো হয়েছিল।

বিগত ৬ সপ্তাহে মেক্সিকোর অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের পরিচালিত ‘জিরো টলারেন্স নীতির বলি হয়েছে ১ হাজার ৯৯৫ শিশু। অতীতে মেক্সিকো সীমান্ত পেরিয়ে আমেরিকায় প্রবেশকারীদের অপরাধের রেকর্ড না থাকলে তাদের কেবল অস্থায়ীভাবে আটক রাখা হতো। এ কারণে শিশুরা তাদের অভিভাবকদের সঙ্গেই থাকতে পারত। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া জিরো টলারেন্স নীতিতে সীমান্ত পেরিয়ে আসা সব মানুষকেই আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। শিশুরা আইনের চোখে অপরাধী না হওয়ায় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তাদের জায়গা হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন আটককেন্দ্রে।

গত সোমবার (১৮ জুন) জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন অভিবাসন প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া এই ‘জিরো টলারেন্স নীতি’র তীব্র সমালোচনা করে বলেন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুরা এমন অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হতে পারে, যা তাদেরকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে হবে। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব পেডিয়াট্রিকস প্রেসিডেন্টের একটি পর্যবেক্ষণকে উদ্ধৃত করে রাদ আল হুসেইন বলেন, “শিশুদেরকে তাদের মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করে আটকে রাখাটা ‘সরকার-অনুমোদিত শিশু নির্যাতন’। শিশুদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন চালিয়ে মা-বাবাকে ভয় দেখানো ‘বিবেক বর্জিত’ পদক্ষেপ।”

ট্রাম্পের জিরো টলারেন্স নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার বিশ্ব অভিবাসন ইস্যুতে ট্রাম্পের জিরো টলারেন্সনীতির বিরোধিতা করে সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশসহ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন নেতা নিন্দা জানিয়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা মন্তব্য প্রতিবেদনে সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশ ট্রাম্পের নীতির সমালোচনা করে বলেছেছেন, ‘আমি সীমান্ত সংলগ্ন একটি রাজ্যে বসবাস করি। আমাদের আন্তর্জাতিক সীমান্তগুলোর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য নেওয়া উদ্যোগের প্রশংসা করি আমি। কিন্তু এ জিরো টলারেন্স নীতি নিষ্ঠুর। এটা অনৈতিক। এতে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।’ লরা বুশের মন্তব্য প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে বর্তমান ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের মুখপাত্রও জানান, তিনি (মেলানিয়া) পরিবারের কাছ থেকে শিশুদের বিচ্ছিন্ন করাকে ঘৃণা করেন। তিনি আশা করেন, কংগ্রেসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই পক্ষ শেষ পর্যন্ত অভিবাসন আইন সংস্কারের প্রশ্নে একমত হতে পারবে। মেলানিয়া মনে করেন যাবতীয় আইন অনুসরণের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি দেশ হওয়া উচিত, যার শাসনকার্য পরিচালিত হবে হৃদয়গত বোধ দিয়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist