আর এম রিফাত
বেড়ানো
প্রকৃতি কন্যা সিলেটে ভ্রমণ
বছরজুড়ে থাকে যার যার পেশা বা ব্যক্তিগত কাজের কর্মব্যস্ততা। কারো কারো নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয়। এভাবেই কাটে সবার সময়। যখন কর্মব্যস্ত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষগুলো ভ্রমণের কথা শুনে তখন তাদের মনে ভিন্নরকম অনুভূতি কাজ করে। তেমনি যখন শুনতে পেল শীতকালীন ছুটির মাঝে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি ট্যুরের আয়োজন করছে। এ কথা শুনে সাংবাদিক সমিতির সদস্যরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। প্রতি বছরই স্বল্প পরিসরে হলেও ট্যুরের আয়োজন করে থাকে তারা। করোনাকালীন ছুটির পর ক্লাস-পরীক্ষার পাশাপাশি সংবাদ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত থাকায় তারা ট্যুরের আয়োজন করতে পারেনি। হঠাৎই আয়োজনের কথা শুনে চমৎকৃত হয়ে যায় তারা। পরিকল্পনা হলো ডিসেম্বরের ২৭ তারিখ ট্যুর হবে। বেছে নেওয়া হলো বাংলাদেশের প্রকৃতি কন্যা সিলেট বিভাগকে।
সিলেটের নাম শুনতেই যেন প্রকৃতির প্রতি অতি আবেগ ও ভালোবাসা বেড়ে গেল। মন মানতে চাচ্ছে না, কারণ ২৭ আসতে এখনো সাত দিন দেরি। এক দিন ঠিকই আবেগের সেই মুহূর্তটি উপস্থিত হলো। ২৭ ডিসেম্বর, ওইদিন সবাই যার যার মতো ব্যাগ গুছিয়ে ২টার মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামের সামনে এসে হাজির। এসে দেখে তাদের জন্য বাস রেডি। ৩টা ৫ বাজতেই যাত্রা শুরু হলো। সবার দারুণ উৎফুল্ল। চারদিকের প্রাকৃতিক রূপ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কারো কারো চোখে ঘুম ঘুম ভাব, কেউ কেউ বাসের সিটে মাথা এলিয়ে দিচ্ছে। এ সময় একজন হুট করে বলে উঠল আমরা এখন পদ্মা সেতুর খুব কাছে।
সবারই আগ্রহের জায়গা পদ্মা সেতু, তাও আবার নিজ চোখে দেখার। মোবাইল বের করে সবাই জানালার পাশ ঘেঁষে সেতুর স্মৃতি মোবাইলে ধারণ করছে। ছবি ভিডিও করতে করতে একসময় সেতু পার হয়ে গেল। শুরু হলো আড্ডা। কেউ গান ধরেছো তো কেউ অভিনয় করছে। কেউ আপন মনে সব উপভোগ করছে। আবার অনেকেই মোবাইলে বুঁদ হয়ে আছে, কেউ নিবিড় শয্যায় ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে।
এরই মধ্যে চলে এলাম ঢাকাতে। ভ্রমণের আগেই কথা দিয়েছেন বণিক বার্তার সিনিয়র রিপোর্টার ও সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি ইমামুল হাসান আদনান ভাই সবাইকে রাতের খাবার খাওয়াবেন। তাই সবাই মিলে খেলাম। খাওয়ার পর পুরাতন নতুনের মিলন মেলা শেষে বাস ছুটে সিলেটের উদ্দেশে।
চলছে বাস চলছে ঘুমের আসর। চোখ মেলতেই পরদিন ভোর অর্থাৎ ২৮ তারিখ আমরা গন্তব্যে এসে পৌঁছলাম। উঠলাম সিলেট শহরে প্লাজা হোটেলে। ফ্রেস হয়ে সকালের নাশতা শেষে রওনা হলাম ভোলাগঞ্জে সাদাপাথরের দেশে। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই এসে গেলাম সেখানে। সাদাপাথরের ভেতরে প্রবেশ করতেই অসম্ভব সৌন্দর্যের দেখা পেলাম। ঝরনা বেয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি, এই পানি আবার পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। পাশেই ভারত সীমান্ত। ওপাশের পাহাড়গুলো যেন অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। পানির সনসন শব্দে হৃদয়ের মাঝে তৈরি হয় ব্যাকুল স্পন্দন। ডিএসএলআর ও মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে ছবি তুলতে। জলকেলি করছে অনেকেই, এভাবে সবাই প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করছে।
নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করা শেষে চলে আসলাম সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম রাতারগুলের মিঠাপানির জলাবনে। পৃথিবীতে মিঠাপানির যে ২২টি মাত্র জলাবন আছে, ‘রাতারগুল জলাবন’ তার মধ্যে অন্যতম। মিঠা পানির এই জলাবন দেখতে হাজার হাজার পর্যটক এখানে আসে। পর্যটকদের মাতিয়ে জলাবন দেখানোর পাশাপাশি গানে গানে পর্যটকদের আনন্দে মাতিয়ে রাখে এখানের বুট নৌকার মাঝিরা। অধিকাংশ নৌকাচালকই অল্প বয়সের। তাদের অসাধারণ কণ্ঠে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার গান পরিবেশন করে শোনান তারা।
নৌকা বাইচে মাঝিদের গান রাতারগুল মাতিয়ে রাখে সব সময়। যা জলাবনে আসা দর্শনার্থীরা উপভোগ করে। জলাবন দেখা শেষে ফিরলাম সিলেট শহরে। চলে গেলাম হজরত শাহজালালের (র.) মাজার ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে। ঘোরাঘুরি শেষ হলে রাতের খাবার শেষে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়।
ঘুম ভাঙতেই ২৯ তারিখ। ফ্রেস ও সকালের নাশতা শেষে খুব ভোরে সবাই জাফলংয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলাম। একটা কথা না বললেই নয়, সকালের নাশতাটি ছিল বিখ্যাত পানশী হোটেলের খিচুড়ি। খুবই মজাদার। আবার গান ও আড্ডায় মুখরিত বাস, বাস থেকে ডান পাশে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ভারতের ছোট-বড় পাহাড়। পাহাড় দেখতে দেখতে জাফলংয়ে এসে পড়লাম। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ। যা জাফলংয়ের অন্যতম আকর্ষণ।
খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সবুজ গাছপালা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ এবং ডাউকি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অবিরাম প্রবহমান জলপ্রপাত দেখলেই মন ভরে যায়। মনে হয় জাফলংয়ের অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভ্রমণপিপাসুদের তৃষ্ণা মিটিয়ে দিয়েছে।
সময় শেষে আবার বাস চলতে শুরু করে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের উদ্দেশে। দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর এখানে আসি। প্রথম স্পট ছিল লাওয়াছড়া, সেখানের পরিবেশ উপভোগ শেষে এসে পড়লাম চা বাগানে। বাস থেকে নেমেই সবাই পাহাড়জুড়ে সবুজ মায়াময় চা বাগান ঘুরে ঘুরে দেখছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত খুবই আনন্দে মুহূর্তটি কেটেছে। এদিকে রাত হয়ে গেল কিন্তু এখনো চা খাওয়া হলো না। শ্রীমঙ্গলে আসলাম অথচ চা খাব না তা হয় নাকি। দেরি না করে চলে আসলাম চা খেতে, এমন স্বাদের চা কখনো খাওয়া হয়নি। একদিকে চলছে চা উৎসব অন্যদিকে চায়ের প্যাকেট কেনাকাটা। চা খাওয়া শেষে উপভোগ করলাম
পাহাড়ি আনারস।
সময় হয়ে এলো ফেরার, চলে আসলাম সিলেট শহরে। রাত কাটিয়ে ৩০ তারিখ ভোরে নতুন পরিকল্পনায় বাস ছুটে চললো কুমিল্লার উদ্দেশে। দুপুর গড়িয়ে গেলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) পৌছেই দুপুরের খাবার খেলাম। খাবার শেষে কুবি, শালবন বিহার, বৌদ্ধমন্দির, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বা বার্ড ও ধর্মসাগর পরিদর্শন করলাম। বিশেষ করে বার্ডের ভেতরে বিশুদ্ধ নির্মল প্রকৃতি যেন দোল খাচ্ছে। এত পরিচ্ছন্ন একটি প্রতিষ্ঠান, এত সুন্দর শৈল্পিক তার অবকাঠামো, এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিয়ে আসা-যাওয়ার জন্য ছাদযুক্ত ওয়াকওয়ে, আর তারই পাশেই নানা রঙের ফুলের বাগান কার না চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে সবার কাছে এই স্থানটি ভালো লেগেছে। তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (কুবিসাস) কথা না বললেই নয়, তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করেছে। যতক্ষণ কুমিল্লায় আমরা ছিলাম সার্বক্ষণিক তারা আমাদের জন্য ছোটাছুটি করেছে। তাদের জন্য আমাদের কুমিল্লা ভ্রমণ সহজ হয়েছে।
সিলেট ও কুমিল্লা ভ্রমণ শেষে আমাদের ২০২২ এর ট্যুর প্রায় সমাপ্তির পথে চলে আসে। কুবিসাস ইবিসাসকে বিদায় জানানোর পর বাস চলতে শুরু করে ক্যাম্পাসের পথে। টানা তিন দিন চার রাত ভ্রমণ শেষে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। হাজারো স্মৃতির মিলন এসে জড়ো হলো। মনের কোণে রয়ে যাবে সিলেট ও কুমিল্লার স্মৃতিচারণ। হাসি-আনন্দে সারাক্ষণ অতিবাহিত হয় আমাদের এ যাত্রা। ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে তোলা হয় নানা ভঙ্গিমায় স্থিরচিত্র। স্মৃতির পাতায় স্মৃতিময় হয়ে থাকবে সিলেট ও কুমিল্লা ভ্রমণ।
"