আজাহারুল ইসলাম

  ১২ ডিসেম্বর, ২০২২

রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি ও আমাদের জাতীয় সংগীত

১৮৯১ সাল। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৩০। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদেশে জমিদারি তদারকি করতে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন। আর এখানেই তার সাহিত্যের এক স্বর্ণযুগ কাটে। জমিদারির পাশাপাশি এখানে বসে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন গীতাঞ্জলি। যা রবীন্দ্রনাথকে এনে দিয়েছে নোবেল পুরস্কার আর বিশ্বকবির মর্যাদা। এছাড়াও তিনি এখানে বসেই আমাদের জাতীয় সংগীত, কাব্যগ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালীসহ অসংখ্য কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন। নিরিবিলি পরিবেশ, জমিদারি আর ব্যবসার কারণে বারবার কুষ্টিয়ার এই কুঠিবাড়িতে ফিরে আসতেন তিনি।

তখন ১৯০৫ সাল। তার বয়স ৪৪। এই কুঠিবাড়িতেই কবি রচনা করেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীতটি। ওই বছরের ৭ আগস্ট কলকাতা টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সভা উপলক্ষে রচিত হয় এই সংগীত। এটি কবির স্বাক্ষরসহ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সঞ্জীবনী পত্রিকায় (২২ ভাদ্র, ১৩১২ সংখ্যা)। দাদরা তালাশ্রিত এই গানটি বাউল সুরে সুরারোপিত; শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুরের সঙ্গে মিল রেখে সুর করেছিলেন কবি।

পরে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়।

কুষ্টিয়া শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে অবস্থিত কুমারখালি উপজেলার একটি গ্রাম শিলাইদহ। আর এই সবুজ ছায়াঘেরা ফুল, ফল আর বিচিত্র গাঠগাছালিতে ঠাসাসৌম্য গ্রামেই রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি। ১১ একর জায়গাজুড়ে মিশে আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা স্মৃতি। আর তিনতলা বিশিষ্ট মূল বাড়িটি আড়াই বিঘা জায়গাজুড়ে রয়েছে। তিনতলা বিশিষ্ট রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়িটিতে মোট ১৮টি কক্ষ, ১৭টি দরজা ও ৩০টি জানালা রয়েছে। ভবনের তৃতীয় তলায় ছিল কবির লেখার ঘর। কুঠিবাড়ির ছাদ থেকে কবি সুর্যোদয়, সূর্যাস্তে এবং জ্যোৎস্না উপভোগ করতেন। তার এই মুগ্ধতা তিনি বিভিন্ন কাব্যে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। বিশ্বকবির অবস্থানকালে জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদারসহ তৎকালীন বঙ্গের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও কবি-সাহিত্যিক এখানে এসেছেন। সম্পূর্ণ কুঠিবাড়িটি বেষ্টনী প্রাচীরে ঘেরা। এখানে রয়েছে চিরসবুজ বৃক্ষ, একটি পুষ্পদ্যোন ও দুটি পুকুর। পশ্চিম দিকের পুুকুর পাড়ে রবি ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত বকুল গাছের পাশে সাড়ি সাড়ি গাছ লাগানো হয়েছে। সেখানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, বাংলাশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুরসহ বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তি কবির স্মৃতির সঙ্গে মিল রেখে বকুল গাছ লাগিয়েছেন।

এছাড়াও চারদিক জুড়ে রয়েছে কবিগুরুর স্মৃতিবিজরিত বিভিন্ন প্রজাতির আম, কাঁঠাল, জাম, শিউলি, বকুলসহ বিভিন্ন ফুল-ফলের গাছ, টেনিস মাঠ, বসার ছাউনি, ডাক বাঙলো, রবীন্দ্র লাইব্রেরি, রবীন্দ্র মঞ্চ, রবীন্দ্রনাথের সময়কার পাতকুয়ো, গোসল খানা, রান্নাঘর, পুকুরসহ অনেক কিছু। ভবনটির প্রবেশমুখে যে তোরণ রয়েছে তা সাধারণ হলেও বেশ আকর্ষণীয়।

শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িটি ১৯৫৮ সাল থেকে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর কক্ষগুলোর দেয়ালজুড়ে স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ের আঁকা ছবি, আলোকচিত্র, কবিতা কিংবা বাল্যকাল থেকে মৃত্যুসজ্জা পর্যন্ত ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে কাটানো বিভিন্ন সময়ের ছবি। এছাড়াও তার ব্যবহার্য ও বাড়ির কাজে ব্যবহৃত জিনিস যেমন খাট, টেবিল, খাজনা আদায়ের টেবিল, সোফাসেট, পালংক, আলমারি, ঘাস কাটার যন্ত্র, ২, ৪ ও ৮ বেহারার পালকি, পল্টুন, কাঠের চেয়ার, চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটো স্পিডবোটসহ নানা জিনিস কক্ষগুলোতে সাজানো রয়েছে। এছাড়া দোতলার ওপরের পিরামিড আকৃতির ছাদ ভবনটির সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়েছে। ভবনটির নির্মাণশৈলী নজরকাড়ে যে কারো। তাইতো সারা বছরই দেশ-বিদেশ থেকে রবীন্দ্রপ্রেমী ও পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। অনেকেই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি যেন কবিগুরুর সান্নিধ্য পায়। পাবনা থেকে আসা এক পর্যটক ডা. পিন্টু রঞ্জন রায় বলেন, ‘কবি গুরুর ভালোবাসা নিয়ে তার কুঠিবাড়িতে আসা। এখানে এতে তার কথা মনে পড়ে যায়। মননে ভাবি, তার কাছে বার বার ফিরে আসি, আবার তার কথা ভাবি। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে হয়ে ওঠে না। আবার যখন ফিরে আসি তখন ভাবের উদয় হয়। তখন যেন মনে হয় কবি এখানে আছেন।’ সুদূর চট্টগ্রাম থেকে আসা অর্পিতা নন্দী বলেন, ‘রবিন্দ্র কুঠিবাড়ি অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। রবি ঠাকুর সবসময় আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করে। রবী ঠাকুর এই জায়গায় ছিলেন, তার স্মৃতিবিজরিত জায়গাটা অনেক বেশি মনোমুগ্ধকর। প্রিয় কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র খুব কাছে দেখতে পাচ্ছি, তার পরিবার-পরিজনের বিষয়ে আরো বেশি জানতে পারছি এটি মন জুড়ানোর মতো। এখানে যে কেউ আসলে এই কুঠিবাড়ির প্রেমে পড়ে যাবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close