সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

  ০৩ মার্চ, ২০১৭

শেকস্পিয়রের নাটকে নারী

উইলিয়াম শেকস্পিয়রের (১৫৬৪-১৬১৬) অনেক গুণের মধ্যে একটি হলো সেটি, যেটিকে কবি-সমালোচক কোলরিজ বলেছেন ‘কাব্যিক বিশ্বাস’ সৃষ্টির ক্ষমতা। যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তারা অবশ্যই মিথ্যা কথা বলেনÑসে তো জানা সত্য; কিন্তু লেখকের ক্ষমতা থাকে পাঠককে অল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের অবিশ্বাসকে স্বেচ্ছায় স্থগিত করতে বাধ্য করার। অবিশ্বাসের এই স্বেচ্ছা স্থগিতকরণকেই কোলরিজ বলেছেন ‘কাব্যিক বিশ্বাস’। প্রসারিত করে একে বলা যায় শৈল্পিক বিশ্বাস। সব সফল শিল্পীই ওই কাজটি করেন, পাঠক-দর্শক-শ্রোতাকে বাধ্য করে ব্যক্তিগত অবিশ্বাসের কার্যকারিতা স্থগিত রেখে শিল্পী যা নিয়ে এসেছেন সামনে, আপাতত তাতেই বিশ্বাস স্থাপন করতে।

নাট্যকার শেকস্পিয়র সম্পর্কে বলা হয়, তিনি কাহিনীর উদ্ভাবক নন। যেখানে ভালো গল্পের আভাস দেখেছেন, সেখানেই হানা দিয়েছেন। অন্যের লেখা নাটক, প্রচলিত লোককাহিনী, লিপিবদ্ধ ইতিহাস, প্রাচীন সাহিত্যÑ কোনো উৎসই বাদ রাখেননি নাটকের জন্য কাহিনীর কাঠামো খুঁজতে গিয়ে। কিন্তু এটাও সত্য, কাঠামোটাই শুধু নিয়েছেন, অনেক সময় তাকেও দিয়েছেন বদলে। আর ভেতরের প্রাণ, নাটককে যা প্রাণবন্ত রাখে, সেটা সম্পূর্ণ শেকস্পিয়রের নিজস্ব, স্ব-আয়োজিত।

তারপরও সত্য হলো, এই নাট্যকার যে অমন বিশ্বনন্দিত ও সর্বজনীন বলে স্বীকৃত, তার কারণ নাটকের উপাখ্যান নয়। কারণ হচ্ছে, নাটকের ভেতরকার চরিত্র। চরিত্রই প্রধান। চরিত্রই বদলে দিয়েছে কাহিনীর কাঠামো। অনেক সময় পাঠক কিংবা দর্শক হিসেবে ঘটনা আমাদের মনে থাকে না, মনে থাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত, ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত, ঘটনা সৃষ্টিকারী মানুষগুলোকে। এই মানুষগুলো একই সঙ্গে নাট্যকারের সমসাময়িক এবং কালোত্তীর্ণ। অর্থাৎ, যেমন তারা সেকালের, তেমনি তারা চিরকালের।

নাটকের ক্ষেত্রে শেকস্পিয়রের ছিল সেই অসামান্য শক্তি, যেটিকে কোলরিজের মতো আরেকজন রোমান্টিক কবি জন কিটস চিহ্নিত করেছেন নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটি হিসেবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এ হচ্ছে একজন শিল্পীর পক্ষে নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা যে শিল্পীর থাকে, তিনি নিজ ব্যক্তিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন না; নিজের গ-ি অতিক্রম করে এক হয়ে যান তারই উদ্ভাবিত চরিত্রের সঙ্গে। তিনি আর তার নিজের নন, তিনি তারই হাতে তৈরি সব চরিত্রের। বিশেষভাবে কোনো একজনের নন; নির্বিশেষরূপে সবার। যেমন পুরুষের, তেমনি মেয়েদের। নায়কের যেমন, তেমনি আবার দুর্বৃত্তের।

কিন্তু তবু শেকস্পিয়র তো একজন ব্যক্তিও। এই ব্যক্তিটি বাস করছেন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, অবস্থান ছিল তার একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিতে। ব্যক্তিগতভাবে সুখ-দুঃখের নানা রকম অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। তিনি প্রেমেও পড়েছেন। একজন মহিলা তাকে অত্যন্ত জ্বালাতন করেছেনÑ এমন সত্য ভাষণ প্রেমকে উপজীব্য করে লেখা তার সনেটগুলোতে পাওয়া যায়। এই মহিলাকে তিনি কৃষ্ণকায় বলে উল্লেখ করেছেন। আবার এই প্রেমিকার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেও শেকস্পিয়র কার্পণ্য করেননি। প্রেমিকাটি আকর্ষক, রহস্যময় ও ধ্বংসাত্মক, একাধারে।

এটি ব্যক্তি শেকস্পিয়রের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা যে নৈর্ব্যক্তিক নাট্যকারের আঁকা মেয়েদের চরিত্রে প্রতিফলিত হয়নি, তা বলা যাবে না। সেখানেও এমন মেয়ে আছে, যে ধ্বংস করে। যেমন, ‘অ্যান্টনিও অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’র ক্লিওপেট্রা এবং ‘ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা’র ক্রেসিডা। আবার এমনও চরিত্র পাওয়া যাবে, যারা সর্বস্বত্যাগিনী। যেমন, ‘কিং লিয়র’-এর কনিষ্ঠা কন্যা কর্ডেলিয়া, ওথেলো-পতœী ডেসডিমোনা, হ্যামলেট নাটকে বিপন্না ওফেলিয়া। কিন্তু তাদের আত্মত্যাগ করার ক্ষমতা নিজেদের জন্য সুখ বয়ে আনেনি এবং তাদের আপনজনকেও স্বস্তি দেয়নি। বরং যেমন নিজের জন্য, তেমনি ভালোবাসার জনের জন্যও ধ্বংস নিয়ে এসেছে, পথ দেখিয়ে। একই বক্তব্য যুবক রোমিও এবং অল্পবয়সী অতিআন্তরিক জুলিয়েট সম্পর্কেও সত্য। সত্য তা লেডি ম্যাকবেথ সম্পর্কেও। ওই মহিলা যদি অত অনুগত না হতেন তার স্বামীর, অনুক্ষণ অমনভাবে চিন্তা না করতেন স্বামীর উচ্চাকাক্সক্ষা চরিতার্থকরণ-বিষয়ে, তাহলে নিজেও বাঁচতেন, বাঁচতেন তার স্বামীও।

মেয়েরা একটা শক্তি। এই শক্তি দাম্পত্য সুখের ভিত তৈরি করতে পারে, যেমনটা আমরা দেখতে পাই শেকস্পিয়রের কমেডিতে। ট্র্যাজেডিতে যা ধ্বংসাত্মক, সেই শক্তি কমেডিতে সৃজননিমগ্ন। কিন্তু যা-ই করুক, সৃষ্টিতে কিংবা ধ্বংসে মেয়েরা রহস্যময়ই রয়ে যায়। পুরুষ থেকে তারা ভিন্ন। তারা আকর্ষণীয়।

কিন্তু কার জন্য? পুরুষের জন্য এবং পুরুষের দৃষ্টিতে। দৃষ্টিটা যে পুরুষের, এটা মানতেই হবে। মেনে নিয়ে তারপর অন্যসব বিবেচনা। নৈর্ব্যক্তিকতা, নিরপেক্ষতা ইত্যাদিরও একটা সীমা আছে বৈকি, নিতান্ত মানবিক একটি সীমা। শেকস্পিয়র অসামান্য প্রতিভাবান ছিলেন অবশ্যই, কিন্তু অশরীরী ছিলেন না। ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উলফ কল্পনা করেছেন, শেকস্পিয়রের একটি বোন ছিল, নাম তার জুডিথ। ওই মেয়েটিও ছিল ভাইয়ের মতো প্রতিভাবান। ভাইয়ের মতোই সেও বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। কেননা, সে বিয়ে করে নিজেকে নিঃশেষ করতে সম্মত হয়নি। কিন্তু সে নাট্যকার হয়নি, অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে; এবং সেই দুঃখে আত্মহত্যা করেছে। না পালালেও সে নাট্যকার হতো না; ঘর-গৃহস্থালি তাকে শেষ করে দিত। ঘর-গৃহস্থালির ধ্বংসাত্মক ভূমিকার কথা লেনিন বলেছেন। বিপ্লবের পর, ১৯১৯ সালে নারী-শ্রমিকদের এক সম্মেলনে লেনিন বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ঘরকন্না সবচেয়ে অনুৎপাদক, সবচেয়ে বর্বর, সবচেয়ে হাড়ভাঙা শ্রম, যা মেয়েরা করে। এই মেহনত অতিশয় তুচ্ছ। তার মধ্যে এমন কিছু নেই, যা মেয়েদের বিকাশে এতটুকু সাহায্য করে।’ ওই প্রসঙ্গেই লেনিন বলেছিলেন, নারীর ‘অবদমনের কারণ অর্থনৈতিক বটে, কিন্তু অর্থনৈতিক সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করলেও মেয়েরা মুক্ত হবে না, যতদিন না তারা ঘরকন্নার দায়িত্বভার থেকে মুক্ত হন।’ সত্যি সত্যি যদি সমান প্রতিভার একজন বোন থাকত শেকস্পিয়রের এবং যদি তিনি নাটক লিখতেন, তাহলে কিছুটা হলেও নারী-চরিত্রের ভিন্নরূপ হয়তো আমরা পেতাম। কিন্তু কতটা ভিন্ন, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কেননা, নারীকে অবদমিত রাখার ব্যবস্থাটির পরিবর্তন হওয়ার দরুন যদি শেকস্পিয়রের ভগ্নি নাট্যকারও হতেন, পুরোপুরি গৃহবধূ না হয়ে, তবু নারী-অধঃস্তনতার আদর্শবাদ তো রয়েই যেত, থাকত। ঐতিহ্যের যে টান, তার ভেতর থেকেই নারীকে দেখতেন তিনি, বাধ্য হতেন দেখতে। ঐতিহ্যের বাইরে যেতে কতটা পারতেন, কে জানে। কঠিন হতো যাওয়াটা। কেবল ঐতিহ্য নয়, ভার বহন করতে হতো তাকে আদর্শেরও। কাঁধ থেকে আদর্শের বোঝাটা ফেলে দেওয়া সোজা কাজ নয়।

শেকস্পিয়রের সময়ে ইংল্যান্ডে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে মাত্র; তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে কিছু ছিল না। সমাজে তারা প্রধান নয়, সংস্কৃতিতেও তারা প্রান্তবর্তী। শেকস্পিয়র নিজে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোক। তিনি একজন পেশাজীবী। এই পেশাজীবী নাট্যকার একজন অভিনেতাও ছিলেন। পরে গ্লোব থিয়েটারের মালিকের অন্যতম হয়েছেন বলে শোনা যায়। কিন্তু মধ্যবিত্ত তখন নাটক দেখে না; নাটক দেখে বিত্তবান ও সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ তার নিজের জীবনকাহিনী জীবনে বিস্তর দেখে, প্রতিদিনই দেখতে পায়। নাট্যালয়ে গিয়ে কাহিনীর পুনরাভিনয় দেখতে চায় না তারা; বরং চায় বিত্তবানদের জগৎটাকে দেখে আনন্দ পেতে। আর বিত্তবান যারা, তারা কি আর নিচের দিকে তাকাবে, নাটকীয় ঘটনার খোঁজে? নিজেদের দিকে তাকালেও তাকাতে চাইতে পারে, কিন্তু তারা পছন্দ করবে তাদের চেয়েও সম্ভ্রান্ত যারা, কিংবা যারা দূরবর্তী নগরের বা অতীত ইতিহাসের, সেসব মানুষের কা-কারখানা দেখতে।

সেজন্য লক্ষ করা যায়, শেকস্পিয়রের নাটকে মধ্যবিত্ত নেই, গরিব মানুষ আছে যৎসামান্য। নাটকে সবটাই অভিজাতদের কাজকর্ম, তাদের জীবনযাপনের অনুলিখনÑ কখনো গম্ভীর, কখনো কৌতুকপূর্ণ। অভিজাতদের পারস্পরিক সম্পর্ক, সমস্যা, আকর্ষণ-বিকর্ষণই সেখানে প্রধান হয়ে আছে। শেকস্পিয়রের দৃষ্টিভঙ্গিটাও অভিজাতধর্মী। তার নাটকের সর্বজনীনতা ওই ভিত্তির ওপরই গড়ে উঠেছে। তবে ভিত্তিতে আটকে থাকেননি তিনি; গাছ যেমন আটকে থাকে না, মাটির ওপর দাঁড়ায় ঠিকই, কিন্তু উঠে যায় আকাশের দিকে। ওঠে বলেই সে বৃক্ষ, নইলে হতো গুল্মলতা।

শেকস্পিয়র পুরুষ মানুষ। পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিটা কার্যকর, অসামান্য শেকস্পিয়রের ক্ষেত্রেও। সেজন্য মেয়েরা অধঃস্তনই রয়ে গেছে। এই যে শেকস্পিয়রের নায়িকাদের তুলনামূলক অধঃস্তনতার সত্যের স্বীকৃতি আছে। এই সত্য একটি বাস্তবতা। সেকালে মেয়েদের স্থান দ্বিতীয়ই ছিল। এখনো যে তা বদলে গেছে, এমন নয়। প্রথম হয়নি, সমান যে হয়েছে, তাও নয়। তবে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে এখন যেসব প্রশ্ন উঠছে, মেয়েরা নিজেই তুলছে, তখন তা অস্পষ্ট অনুভূতি হতে পারে কারো কারো হৃদয়ে। কিন্তু ধ্বনি হয়ে ওঠেনি, বাক্সময় হতে সময় লেগেছে প্রায় ৩০০ বছর। শেকস্পিয়রের নায়িকাদের নিয়ে ছোট বই লেখা যায়; নায়কদের নিয়ে ছোট বই লেখা কঠিন। সেই বই অনেক বড় হতে বাধ্য। কারণ ওইটাই, পুরুষদের ওই আধিপত্য।

তার কমেডিতে মেয়েরাই প্রধান, অনেক ক’টিতেই। কিন্তু সেই প্রাধান্য সাময়িক এবং তা জীবনে মেয়েদের কর্তৃত্বের স্মারক নয় মোটেই। অধিকাংশ মেয়েরই লক্ষ্য অভিন্নÑ বিয়ে করা। যাত্রা তাদের স্বামীগৃহ অভিমুখে। স্বামীই গৃহ, অনেক ক্ষেত্রে। ইজাবেলা সন্ন্যাসিনী হবে ঠিক করেছে। মঠের চৌকাঠ পেরিয়েই জানতে চেয়েছে, সন্ন্যাসের আইন-কানুন কতটা শক্ত; এবং আরো শক্ত নয় দেখে যেন কিছুটা অসন্তুষ্টই হয়েছে সে। সেই ইজাবেলা কী করল শেষ পর্যন্ত? না, ভিয়েনার ডিউক যেইমাত্র বলেছে, ‘তুমি কি আমার স্ত্রী হবে’, অমনি সঙ্গে সঙ্গে নত মস্তকে রাজি সে। এতটা সম্মত যে, মুখে কোনো রা নেই।

আমরা এও স্মরণ করতে পারি, শেকস্পিয়রের কালে দর্শকদের ভেতর মেয়েদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। তাছাড়া আমরা এও তো জানি, মঞ্চে তখনো মেয়েরা পা দিতে পারেনি। নারীচরিত্র ছিল, কিন্তু নারী অভিনেতা ছিল না। পুরুষরাই অভিনয় করত মেয়েদের ভূমিকায়। সেজন্য মেয়েদের সংখ্যা বেশি করার বাস্তবিক একটা অসুবিধা ছিল। আর সুবিধা হতো তাদেরকে ছদ্মবেশ ধরিতে দিতে পারলে। শেকস্পিয়র কখনো কখনো এই সুবিধা নিয়েছেন বৈকি, রজালিন্ড, পোর্শিয়া, ভায়োলা-তারা ছদ্মবেশ নিয়েছে, ইজাবেলা পরেছে সন্ন্যাসীর পোশাক।

পিডিএসও/মুস্তাফিজ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist